ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

<b>কলকাতার গরিবি দর্শন</b>

সুচরিতা বসু Aug 19, 2020 at 7:19 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

সিরিজ: কলকাতা উইথ স্যু পার্কিন্স (Kolkata with Sue Perkins)

পরিচালক : স্টিভ রবিনসন
চিত্রগ্রহণ : ম্যাট নরম্যান
পরিবেশক : অ্যামাজন প্রাইম

অফিস টাইমের বৌবাজারের গলিতে আটকে পড়া এক বিদেশিনির কাছে কলকাতা যতটা সিন্ধুপারের দেশ, তার চাইতেও বেশি করে অদরকারি হর্নের সমাবেশ। তাই একঘন্টার তথ্যচিত্রের শুরুতেই যখন তিনি বলেন কলকাতা তাঁর কাছে শব্দ-বর্ণ-গন্ধের এক বিচিত্র বিস্ফোরণ, সেকথা বুঝতে আমাদের এতটুকু অসুবিধা হয়নাবিবিসি ওয়ানের সহযোগিতায়, জনপ্রিয় ব্রিটিশ কমেডিয়ান ও সঞ্চালক স্যু পার্কিন্স শহরের চামড়ার ভিতরে ঢুকে তার হয়ে ওঠার গল্প শুনে চলেন

সেদিনের সুতানুটি থেকে আজকের মেট্রো স্টেশন অবধি যে যাত্রাপথ, তাকে সীমিত পরিসরে ধরতে চাওয়ার প্রচেষ্টা প্রায় দুঃসাধ্য এবং এই তথ্যচিত্র ঠিক কোন্‌ ম্যাপ ধরে সেই পথ খুঁজতে চেয়েছে তা ক্ষেত্রবিশেষে দুর্বোধ্য। স্যু-এর দিনযাপন শুরু হয় মাটির ভাঁড় তৈরির কারিগরদের সঙ্গে; তাদের কাজের ধরন, জীবনের চলন বোঝার মধ্যে দিয়ে শহরের দিন-আনি-দিন-খাইয়ের সহজপাঠ পড়ার চেষ্টা করেন তিনি। সেখান থেকে চিনেপাড়ার মন্দিরে বুড়িছোঁয়া করে ঢুকে যান বো ব্যারাকের সাংসারিক খুঁটিনাটিতে, শুরু হয় ব্রিটিশ গৌরবগাথার স্মৃতিচারণ। শহরের শিল্প-সমৃদ্ধির অতীতকে জানার চেষ্টায় স্যু আসেন পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়িতে। আলাপচারিতায় স্পষ্ট হতে থাকে, শিল্পচর্চার প্রেক্ষাপটের থেকেও রাস্তার দুইধারে বিত্ত-বৈভবের এমন বিসদৃশ বৈষম্য তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই হয়তো নেটিভ রাজবাড়ি ছেড়ে স্যু রওনা দেন মাটির নিচে, শহরের প্রাচীনতম নিকাশিনালার অভ্যন্তরে। সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি উঁকি মারেন পথবাসী শিশুদের জীবনে, তাদের একরাতের আলাদিন হয়ে কিছু খুশির মুহূর্ত উপহার দিয়ে যান। অদ্ভুতভাবেই কলকাতার উন্নয়নের উঠতি রেখচিত্র বোঝাতে তাঁরা বেছে নেন নিউ টাউনের রাস্তায় গতির সওয়ারি হওয়া ধনকুবের যুবকদের এবং এইখানেই তাঁদের শহরদর্শনের ইতি।


আরও পড়ুন

আত্মহত্যা ও অমরত্বের রোলার কোস্টার


সেই প্রাচীনকালের প্যাট্রিক সোয়েইজ থেকে হাল আমলের স্যু পার্কিন্স, এই আধাকপালি বঙ্গদেশে যাঁরাই এসেছেন, সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের বে-আব্রু দারিদ্র্যটুকু তাঁদের ক্যামেরায় জায়গা করে নিয়েছে। সেই হৃতসর্বস্ব গরিবির আখ্যানে আমাদের মধ্যবিত্ত অস্বস্তি থাকলেও, কলকাতার তাতে কোন লজ্জা নেই। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের যে কোন বড় শহর মাত্রেই বিত্তের চরমতম ফারাকের এক আশ্চর্য ভাবলেশহীন চোরাস্রোত বয়ে নিয়ে চলে, এ শহরও ব্যতিক্রম নয় আসলে কলকাতাকে দেখার অনেকরকম চশমা আছে; আঁতেল চশমা, অভিজাত চশমা, নিন্দুক কিংবা নস্টালজিক চশমাস্যু পার্কিন্স তাঁর কলকাতা দেখার জন্য বেছে নিয়েছেন কলোনিয়াল হ্যাংওভারের চশমা। সেকথা স্পষ্ট হয়ে যায় যখন গল্পের শুরুতেই কলকাতার বর্ণনায় তিনি বলেন, এই বন্দর-শহরে এককালে উৎকৃষ্ট পণ্য আসতো এবং এখানকার সম্পদ চলে যেত “back where it really belonged”, অর্থাৎ ব্রিটেন! তাই ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে দাঁড়িয়ে তিনি, আশ্রয়হীন জীবনের নিরিখে বিত্তশালী স্থাপত্য টিকিয়ে রাখার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। শহরের নিকাশি ব্যবস্থা তাই তাঁর কাছে ব্রিটিশ প্রযুক্তিবিদ্যার অতুলনীয় দানমাত্রতাঁর নিজের মুখেই, কলকাতা মানে মাদার টেরেসা আর অন্ধকূপ হত্যা; কলকাতার এগিয়ে চলা মানে অন্ধকূপ থেকে জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে ওঠার গল্প। স্যু ভুলে যান, ব্রিটিশরা কলকাতাকে দেশের রাজধানী বানানোর সময়ে জাঁকজমকে কোন খামতি রাখেনি; কলকাতা বন্দর ঘিরে বাণিজ্য ফুলেফেঁপে ওঠার সময়ে শহরকে অন্ধকূপ বলে কারও মনে হয়নি। গৃহহীনতার হতাশায়, কুমোরপাড়ার প্রাত্যহিক কিস্যায় কিংবা আশ্রয়হীন কচিকাঁচাদের স্কুল যাওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষায় স্যু যতবার কাতর হন, ততবার তাঁর ভাষ্যে এই দুর্দশা শহরের হেরে যাওয়ার নামান্তর হয়ে ওঠে। তাই বো ব্যারাকের ঘরে বসে তাঁর প্রশ্নের উত্তরে পরিবারের সদস্যা যখন বলেন, ব্রিটিশরা কলকাতায় ফিরে এলে তারা খুশিই হবেন, সেই খুশির ছাপ দেখা যায় স্যু-এর মুখেও।

সম্ভবত এই সিরিজের সবচাইতে করুণ এবং হাস্যকর নির্মাণ শহরের উন্নতির চিত্রায়ণে। ব্যবসায়ী পরিবারের যুবরাজদের ‘সুপারকার ক্লাব’ স্যু-এর চোখে শহরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মাপকাঠি। রিয়েল এস্টেটের ব্যাবসায় যুক্ত এক তরুণের সঙ্গে স্যু-এর কথোপকথন শুনলে সন্দেহ জাগে, কোন্‌টা বেশি চিত্তাকর্ষক? সিরিজনির্মাতার নির্বুদ্ধিতা না ওই যুবকের ল্যাম্বর্গিনি? এমনকি পথশিশুদের সঙ্গে খেলায় সামিল হতে গিয়ে স্যু-এর ‘টুইঙ্কল টুইঙ্কল’ আবৃত্তি যখন সমবেত ‘জনি জনি ইয়েস পাপা’তে ঢাকা পড়ে যায়, তখন সেই ছড়াও তাঁর কাছে অচেনা ঠেকে। নির্মাতাদের মনে হয় বাচ্চারা বোধহয় তাদের স্বর্গত পিতাদের স্মরণ করছে! অথচ ফুটপাথে অতিবাহিত এই জীবনচর্যাই এই সিরিজের একমাত্র কর্কশ সত্যের আখ্যান। এই মানুষগুলোকে আমাদের মধ্যবিত্তি ভালোথাকার ছবিতে আমরা কখনোই স্থান দিই না, শহরের রোজনামচায় এদের অস্তিত্ব স্বীকার করলেও তা নিয়ে আলোচনা করি না। শিক্ষার অধিকার নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসে গলা ফাটানোর সময়ে এই বাচ্চাগুলোর মুখ কখনও মনে পড়ে না। হোপ ফাউন্ডেশনের গীতার মতো মানুষ আছেন বলেই, রাখির মতো মাতৃহীন, সম্বলহীন শিশুও স্কুলে অনুপস্থিত থাকতে চায় না। আধাখ্যাঁচড়া নির্মাণে এবং ক্রমাগত একরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সিরিজের ওইটুকু প্রাপ্তিও হাতছাড়া হয়।

কলকাতার প্রাণশক্তিকে আসলে কোন একমুখী ভাষ্যে ধরাই যায় না। হাজারো অপ্রাপ্তির ভিড়ে কলকাতার প্রাপ্তি তার নিরন্তর শিল্পচর্চা। দৈনন্দিন আপোসের ভিড়ে কলকাতার শিরদাঁড়া তার ছাত্র আন্দোলন। প্যান্ডেলের সামনের ফুচকার দোকানে সমস্ত ধনবৈষম্য এক পংক্তিতে দাঁড়িয়ে ফাউয়ের আবদার করে; শহর কলকাতা তার উদ্‌যাপনের প্রাণময়তায় জীবনকে আলগোছে নিতে শেখায়, যাপনকে শিকড় থেকে চিনতে শেখায়। যতদিন ইউরোপীয় প্রযোজকরা কোন শহরকে তার শিক্ষা-সংস্কৃতির মূল সুরটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার অভ্যাস ত্যাগ না করবেন, ততদিন কলকাতা তাদের কাছে সাম্রাজ্যবাদের ছিবড়ে ছাড়া অন্য কিছু হয়ে উঠতে পারবে না। তাতে কলকাতার কোনই ক্ষতি নেই, অল্প কিছু নির্বোধের হতাশা বাড়বে শুধু। 

#ওয়েব সিরিজ রিভিউ #সুচরিতা বসু #কলকাতা #কলকাতার গরিবি দর্শন #Sue Parkins

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

15

Unique Visitors

182740