ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

উদারপন্থী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও নাগরিকজীবনের এক কঠোর বাস্তবতা – 'আই, ড্যানিয়েল ব্লেক'

অলর্ক বড়াল Jan 16, 2021 at 5:27 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

ফিল্ম রিভিউ – ‘আই, ড্যানিয়েল ব্লেক‌’ (২০১৬)
দৈর্ঘ্য – ১ ঘন্টা ৪০ মিনিট
প্রযোজক – রেবেকা ও’ব্রায়ান
নির্দেশক – কেন্‌ লোচ্‌
চিত্রনাট্য – পল্‌ লেভার্টি
সিনেমাটোগ্রাফি – র’বি রায়ান
অভিনয় – ডেভ্‌ জন্স্‌ (ড্যানিয়েল ব্লেক), হেইলি স্কোয়ারস্‌ (কেটি), শ্যারন্‌ পার্সি (শেইলা), কেট্‌ রাটার (অ্যান্) প্রমুখ

আপনার কি কখনো মনে হয়েছে যে সরকারী পরিষেবামূলক ব্যবস্থাগুলোতে ইচ্ছে করেই মানুষকে সেইসব সুযোগসুবিধাগুলো পাওয়া থেকে আটকানোর চেষ্টা করা হয় যেগুলো দেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থাগুলোর উৎপত্তি; ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়ানো বা হেল্পলাইনের নম্বরের ক্রমাগত ‘আপনার কলটি অপেক্ষারত রয়েছে’ বার্তার একঘেঁয়ে স্বরের একমাত্র লক্ষ্য আপনার সমস্যাগুলির বিষয়ে প্রশ্ন করার ইচ্ছাকে দমিয়ে দেওয়া, পাতার পর পাতা ফর্ম পূরণের সঙ্গে অসংখ্য কাগজপত্রের প্রয়োজনীয়তা কেবল আপনাকে ভুলের ভুলভুলাইয়াতে পাঠানোর প্রয়াসমাত্র। উত্তর সদর্থক হোক কিংবা নঞর্থক ২০১৬ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে “পাম ডি’অর” জয়ী এই সিনেমাটি দেখলে এর কাহিনির সাথে আপনি নিঃসন্দেহে নিজের অবস্থার মিল খুঁজে পাবেন।             

কেন্‌ লোচ্‌ নির্দেশিত সামাজিক-রাজনৈতিক ছবি “আই, ড্যানিয়েল ব্লেক” আদতে আমাদের অনুভূতির ওপর এক সজোরে আঘাত। লোচের প্রায় সকল সিনেমাতেই দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে ঘটে যাওয়া অন্যায় ও তার বিরোধিতার থিমই প্রাধান্য পায়। সরাসরি সরকারের তরফে অন্যায় কাজকর্ম না দেখালেও প্রতিটি চরিত্রের ওপর সেই কাজগুলির বিরূপ প্রভাব অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তোলাই লোচের ‘ইউএসপি’ যা তিনি এই সিনেমার প্রথমেই দেখিয়েছেন উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডের নিউক্যাসল্‌ শহরের ৫৯ বছরের এক কাঠমিস্ত্রী, ড্যানিয়েল ব্লেকের মাধ্যমে – যিনি অ্যারিদ্‌মিয়া বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের রোগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন; প্রাণহানির সমূহ সম্ভাবনায় ডাক্তারের কাছ থেকে সুস্থ না হয়ে কাজে যোগ না দেওয়ার মৃত্যু-পরোয়ানারূপী নিদান পেয়ে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে তিনি সরকারী এমপ্লয়মেন্ট সাপোর্ট ব্যবস্থার সাহায্য নিতে যান। এরপর কালো পর্দায় অন্য কোনোরূপ দৃশ্য ছাড়া শুধুমাত্র কথোপকথনে দেখানো হয় স্বাস্থ্যব্যবস্থায় চরম অব্যবস্থার অন্ধকারাচ্ছন্ন ছবি যেখানে এক হৃদরোগীর অসুস্থতার পর্যালোচনা হয় রোগীর ৫০ মিটার কোনোরকম সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারা, বুক পকেটে হাত ঢোকাতে পারা, মাথার ওপরে হাত তুলতে পারার সক্ষমতার ভিত্তিতে সরকারী অনুমোদনপ্রাপ্ত কোনো এক প্রাইভেট সংস্থার মেডিক্যাল ডিগ্রিবিহীন কর্মীর দ্বারা।  

গণপরিবহণের অব্যবস্থার দোষে কয়েক মিনিট দেরিতে সরকারী দপ্তরে পৌঁছানো কেটিকে তার সন্তানদের সাথেই তাড়িয়ে দিতে উদ্যত অফিসারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে নিজের মতই দুর্দশায় জর্জরিত কন্যাসম কেটির পাশে দাঁড়াতে একপলকও ভাবতে হয় না বিপত্নীক ড্যানিয়েলকে। তার নিঃসঙ্গ জীবনে কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে কেটি ও কেটির ছেলেমেয়ে-ই। কেটি যার উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন জীবনযুদ্ধের বলি হয়েছে তার কাছে ড্যানিয়েল হয়ে ওঠেন আপনজন। সমাজব্যবস্থার জরাজীর্ণতা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার ভেসে ওঠে যখন দেখা যায় কেটি নিজের সন্তানের সামান্য ইচ্ছাপূরণের জন্য বাধ্য হয় দেহব্যবসাকে বেছে নিতে, কিংবা যখন ক্ষিদের জ্বালায় সে বাধ্য হয় ফুডব্যাঙ্ক থেকে খাবার চুরি করতে। অন্যদিকে, জীবনধারণের জন্য কাজ খুঁজে পেলেও তাতে যোগ দিতে পারেন না ড্যানিয়েল, কারণ এমপ্লয়মেন্ট সাপোর্ট ব্যবস্থায় তার অসুস্থতার পর্যালোচনা অনুযায়ী তার কায়িক শ্রম করা নিষিদ্ধ, অথচ এর পরিবর্তে তার প্রাপ্ত সরকারী ভাতার পরিমাণ জীবনধারণের অনুপযুক্ত। বর্তমানের দ্রুতগতির টেকনোলজি-নির্ভর জীবন ড্যানিয়েলের মতো বয়ঃজ্যেষ্ঠদের কাছে কতটা দুরূহ তাও লোচ একটি মজাদার দৃশ্যের মাধ্যমে উপস্থাপিত করেছেন এবং দেখিয়েছেন এইসব সুবিধা কিভাবে একজন অনাধুনিক ব্যক্তির জীবনে মারাত্মক অসুবিধার সৃষ্টি করে দেয় তা সমাজ ধরতেই পারে না। এহেন পরিস্থিতিতে ড্যানিয়েল তার প্রাপ্য আইনি শুনানির সুযোগ পাওয়া থেকে বারবার বঞ্চিত হলে রাগে-ক্ষোভে-হতাশায় সরকারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সরকারী অফিসের দেওয়ালে কালি দিয়ে লিখে দেন তার ন্যায্য দাবির কথা।


বহু প্রতীক্ষিত সেই শুনানির ঠিক পূর্বে ড্যানিয়েলের হৃদরোগে মৃত্যু ও ছবির শেষে তাঁর শেষকৃত্যে কেটির গলায় ড্যানিয়েলের লেখা চিঠি পাঠ যেন উদারপন্থী রাষ্ট্রের সম্পদ বন্টনের মেকি নিয়মের শিকার হওয়া অগণিত মানুষের আকুতির স্বর – মানুষ ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের দর্পণ, রাষ্ট্রের তথাকথিত উদারবাদী ভাষ্যে নাগরিকের অমানবিকীরণ এবং ‘ক্লায়েন্ট’, ‘কাস্টমার’ ও ‘ইন্স্যুরেন্স নম্বর’-এ পর্যবসিত করার বিরুদ্ধে অবিচ্ছেদ্য মানবিক সত্ত্বার দৃপ্ত প্রকাশ :   

“I am not a client, a customer, nor a service user.

I am not a shirker, a scrounger, a beggar, nor a thief.

I am not a National Insurance Number or a blip in the screen.

I paid my dues, never a penny short and proud to do so.

I don’t tug the forelock, but look my neighbour in the eye and help him if I can.

I don’t accept or seek charity.

My name is Daniel Blake, I am a man, not a dog.

As such, I demand my rights.

I demand you treat me with respect.

I, Daniel Blake, am a citizen, nothing more and nothing less.

              Thank you.”

ধারাগত ও প্রায়োগিক দিক থেকে সিনেমাটি ‘সোশ্যাল-রিয়ালিজম্‌’-এর এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নির্দেশক কর্তৃক হাল্কা ধূসর টোনে ‘ন্যাচারাল লাইটিং’-এর প্রয়োগ ব্রিটেনের বাস্তব ছবির পাশাপাশি নিউক্যাসল্ শিল্প-শহরের একটা ‘রিয়েল ফিল’ এনে দেয় দর্শকের চোখে, ‘লো-কী’ লাইটিংয়ের ব্যবহার ও তার সঙ্গে সকল চরিত্রের পরিশীলিত অভিনয় গোটা কাহিনীর বিষণ্ণতার সাথে সাযুজ্য রেখে চলে। এসবের সঙ্গেই সংলাপে ইংরাজীর ‘জর্ডি’ (উত্তর-পূর্ব ব্রিটেনের টাইন নদীতীরের অঞ্চলের) ভাষাবৈচিত্র্যের দুর্দান্ত প্রয়োগ সিনেমাটিকে অসাধারণ আঞ্চলিকতার ছোঁয়া দিয়েছে। 


একবিংশ শতকে আজ যখন রাজনীতি ও রাজনৈতিক ছবি – দুইয়েরই কেন্দ্রবিন্দু ‘নাগরিক-রাষ্ট্র’ সম্পর্কের সমীকরণ থেকে বিচ্যুত হয়ে ব্যক্তিসর্বস্ব ও দলসর্বস্ব হয়ে স্রেফ কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি ও ভিত্তিহীন অযৌক্তিক প্রশংসার মঞ্চে পর্যবসিত হয়েছে তখন লোচের এই ছবি নিঃসন্দেহে স্থান-কাল-দেশের গণ্ডির উর্দ্ধে উঠে কঠিন বাস্তবের মোড়কে এক টুকরো জীবন-আবহ। 




# Daniel Blake #Ken Loach #Paul Laverty #Dave Johns #Hayley Squires #Palme d'Or # BAFTA Award for Outstanding British Film #Film #Review #রিভিউ #অলর্ক বড়াল #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

17

Unique Visitors

214979