অসংখ্যের আশংকা : পেপসি ও পাটিগণিতের মামলা
জামাকাপড় হোক কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী, কেনাকাটা করার জায়গা যদি হয় আন্তর্জাতিক কোনও সংস্থার ঝাঁ চকচকে দোকান, তবে ক্যাশ কাউন্টারে টাকা মেটানোর সময় নিশ্চিতভাবেই দেখবেন ক্রেডিট পয়েন্টের হাতছানি। নির্দিষ্ট মূল্যের জিনিস কিনলেই আপনার নাম বা মোবাইল নম্বরের খাতায় জমা হবে নির্দিষ্ট পরিমাণ পয়েন্ট, পয়েন্টের ভাঁড়ার ফুলেফেঁপে উঠলে তা ভাঙ্গিয়ে পাবেন নির্দিষ্ট মূল্যের ছাড় অথবা নির্দিষ্ট কোনও উপহার। কাজেই মাসের শেষে বারবার ওই দোকানে ফিরে যাওয়া একরকম নিশ্চিত। দেখতে-শুনতে হাল আমলের হলেও, এই পয়েন্ট-নির্ভর প্রলোভনের শুরুটা সেই নব্বইয়ের দশকের মুক্ত অর্থনীতির হাত ধরেই। মনে করুন, নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের চিউয়িং গাম বা টুথপেস্ট কিনে পাওয়া ক্রিকেটারদের কার্ড জমানোর খেলা! শুধুমাত্র বাচ্চাদের আব্দারের জন্যই বাবা-মায়েরা সেই ব্র্যান্ডের জিনিস কিনতে বাধ্য হতেন। তবে কার্ড হোক কিংবা ক্যাশ ছাড়, সবক্ষেত্রেই উপহারের একটা ঊর্ধ্বসীমা মেনে চলা হয়। শুনতে সহজ, কিন্তু সামান্য ভুলচুক হলেই কোম্পানিকে পড়তে হয় মহা ফাঁপড়ে। যেমনটা হয়েছিল পেপসির সঙ্গে।
সালটা ছিল ১৯৯৫, মার্কিন ঠান্ডা পানীয় পেপসি তখন বিশ্ববাজারে জাঁকিয়ে বসেছে। এমতবস্থায় পেপসি একটা বিজ্ঞাপনী প্রচার চালায় আমেরিকাতে, সেখানে বলা হয় যে নির্দিষ্ট মূল্যের পেপসি পণ্য কিনলে পাওয়া যাবে পয়েন্ট, আর সেই পয়েন্ট জমিয়ে পেপসিকে পাঠালে পাওয়া যাবে ছোটোবড়ো হরেক উপহার। ৭৫ পয়েন্টের বিনিময়ে পাওয়া যাবে টি-শার্ট, ১৭৫ পয়েন্টের বিনিময়ে সানগ্লাস, এমনকি ১৪৫০ পয়েন্টের বিনিময়ে মিলবে ঝকঝকে জ্যাকেট! লোভনীয় প্রচার, সন্দেহ নেই। তাছাড়া এসবকিছু একসঙ্গে সংগ্রহ করতে পারলে যে বন্ধুমহলে বেশ কেউকেট হওয়া যাবে, সেকথাটাও কৌশলে বোঝানো হল বিজ্ঞাপনের ছেলেটিকে দেখিয়ে যে এইসব পরেই স্কুলে যায়। এখানেই থেমে যাওয়া যেত, কিন্তু নির্মাতারা ভাবলেন পেপসির মতো একটা ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনের শেষটা চমকদার হওয়া দরকার, তাই তারা দেখালেন এই পেপসিবয় স্কুলে যায় হ্যারিয়ের যুদ্ধবিমান চেপে। তুমিও চাও? জোগাড় করে ফ্যালো ৭০ লক্ষ পয়েন্ট।
স্বাভাবিকভাবেই নির্মাতারা ভেবেছিলেন, এত বেশি পয়েন্ট কারও পক্ষে জমানো সম্ভব না। যদিও পয়সা রোজগারের খাতিরে বলা ছিল যে প্রতি ১০ সেন্টের বিনিময়ে একটা করে পেপসি পয়েন্ট কেনা যেতে পারে, কিন্তু একে তো পয়েন্ট জমা দেওয়ার নির্দিষ্ট সময়সীমা ছিল, তার উপর বেশ কিছু নিয়মও মানতে হত। যেমন, অন্তত ১৫টা পেপসি পয়েন্ট জমা করতেই হবে, সঙ্গে দিতে হবে পেপসি স্টাফ ক্যাটালগ থেকে নেওয়া ফর্ম, তারপর বাকি পয়েন্টের জন্য দাম ধরে দেওয়া যেতে পারে। প্রশ্ন হল, ওই যে ‘এত বেশি’ সেটা আসলে কত বেশি? এভি-৮ হ্যারিয়ের-২ যুদ্ধবিমান কিনতে মার্কিন সেনার তখন খরচ পড়ত দুই কোটি টাকার মতো, সত্তর লক্ষ সংখ্যাটা তার চাইতে কম হলেও, আসলে কতটা কম সে ব্যাপারে কেউ মাথা ঘামায়নি।
ভুল বললাম। জন লিওনার্ড মাথা ঘামিয়েছিল। শুধু মাথাই নয়, হ্যারিয়ের যুদ্ধবিমানে চাপার জন্য সে যথেষ্ট গা ঘামিয়েছিল বললেও অত্যুক্তি হবে না। রীতিমতো উকিল দিয়ে টাকার ব্যবস্থা করে সে পেপসি কোম্পানির দফতরে পাঠাল একটি পেপসি ক্যাটালগ ফর্ম, ১৫টি পেপসি পয়েন্ট আর অতিরিক্ত সাত লক্ষ ডলার। সেইসঙ্গে দাবি করল, বিজ্ঞাপনের শর্ত মেনে হ্যারিয়ের যুদ্ধবিমানটি তার বাড়িতে পাঠানো হোক। পেপসির কর্তারা এমন আজগুবি দাবিকে মোটেই পাত্তা দিলেন না। বিজ্ঞাপনে যা দেখানো হয়েছে সে তো নিছক বিনোদন, অমনটা বাস্তবে হয় নাকি! লিওনার্ড ছাড়ার পাত্র নয়, উকিলের চিঠি এসে হাজির হল পেপসির ঘরে। মালিকরা তখনও ভাবছেন, এ কি আজব রসিকতা! লিওনার্ডের উকিল সোজা মামলা ঠুকে দিল আদালতে। কথায় বলে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ; আদালতের চক্করে পড়ে পেপসির তখন ছত্রিশ দুগুণে বাহাত্তর ঘা খাওয়া দশা। দিনের পর দিন শুধু এই নিয়ে সওয়াল-জবাব চলছে যে বিজ্ঞাপনের মজাকে কি তার অবাস্তবতাতেই মেনে নেওয়া উচিত, নাকি বিজ্ঞাপনে দেখানো মানেই তা বাস্তবে প্রাপ্য? অবস্থা যে কতটা সঙ্গিন হয়েছিল তা খোদ বিচারকের বক্তব্য থেকেই মালুম – “বাদী পক্ষের এই নিরন্তর দাবি, যে টিভিতে দেখানো বিজ্ঞাপনের প্রতিটি কথাকে গুরুত্ব দিতে হবে, আদালতকে বাধ্য করেছে এটা বুঝিয়ে বলতে যে বিজ্ঞাপনটা কেন শুধুই মজার। একটা মজার ব্যাপার ঠিক কেন মজার, এটা বুঝিয়ে বলাই একটা গুরুতর কাজ”। তবু, আইনকে তো তথ্য ও যুক্তির পথেই থাকতে হয়। তাই হ্যারিয়ের জেট বিমান চালিয়ে স্কুলে যাওয়া, জনবহুল জায়গায় তাকে অবতরণ করানো, একগাদা কচিকাঁচাদের ভিড়ে যুদ্ধবিমানের মতো গণবিধ্বংসী অস্ত্রের প্রবেশ – এইসমস্ত বিষয়ের অসারতা দেখিয়ে আদালত রায় দিল, এই বিজ্ঞাপনের মজার অংশটুকুকে অবাস্তব মজা হিসেবেই গ্রহণ করতে হবে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল পেপসি, আর মামলা শেষ হতেই বিজ্ঞাপন পাল্টে সত্তর লক্ষকে সাত কোটি করে দিল। দুকোটি টাকার বিমান সাত কোটিতে কিনতে আর কেউ আগ্রহ দেখায়নি।
পেপসি তো না হয় বেঁচে গেল, কিন্তু যে ফাঁক দিয়ে লিওনার্ড কালনাগ হয়ে ব্যবসার বাসরঘরে ঢুকে পড়েছিল, তা সবার চোখ খুলে দিল। আমরা, মানুষেরা, স্বভাবতই সংখ্যার বিশালতা ঠাহর করে উঠতে পারি না। ‘সত্তর লক্ষ’ শুনতে অনেক বড়ো লাগে ঠিকই, কিন্তু দুই কোটির তুলনায় যে তা অনেক কম এটা পেপসির কর্তারা খেয়াল করেননি। দুকোটির বিমান সত্তর লক্ষতে বাগিয়ে নেওয়ার উপায় থাকলে কোনও না কোনও খ্যাপা যে সে সুযোগ ছাড়বে না, সেটাও তাই কেউ ভেবে দেখেনি। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে প্রতিটি বড় ব্যবসায় যে গণিতবিদ, রাশিবিদদের এত কদর, বিজ্ঞাপনী ঝুঁকি মাপার জন্য যে আলাদা শাখা তৈরি হয়েছে, তার শুরুটা সম্ভবত লিওনার্ডের প্রতিস্পর্ধা থেকেই। অসীম এবং সসীমের মাঝে নিজের বোঝার সীমাটা ঠিক কোথায়, এই ধন্ধে আমরা ঠকেছি সেই প্রাচীনকাল থেকেই। শেষ করার আগে মনে করিয়ে দিই সেই পুরনো লোককথা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদেরই দেশে আবিষ্কৃত এক বিখ্যাত খেলা – দাবা। কথিত আছে, দাবা খেলায় বুদ্ধির মারপ্যাঁচ দেখে দারুণ প্রীত হয়ে রাজা শেরহাম পুরস্কৃত করতে চাইলেন আবিষ্কারক চিসা (মতান্তরে সেসা)-কে। চিসার বিশেষ মাথাব্যথা নেই পুরস্কার নিয়ে, এদিকে রাজারও গোঁ চেপে গেছে। সামান্য এক প্রজা, সে রাজার ইচ্ছার মর্যাদা না দিয়ে পুরস্কার ফেরায় কোন সাহসে? শেষটায় বিরক্ত হয়ে চিসা বলল, মহারাজের যদি এতই ইচ্ছা, তিনি যেন দাবার প্রতিটি ঘর এমন ভাবে গম দিয়ে ভরে দেন যাতে প্রথম ঘরে একটি, পরের ঘরে দুইটি, এইভাবে প্রতি ঘরে আগের ঘরের দ্বিগুণ শস্য থাকে। শেরহাম ভাবলেন, ভারি তো ভিখারির চাওয়া, তার আবার এত দেমাক। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে রাজার হল পেপসির মালিকের মতোই ছেড়ে-দে-মা-কেঁদে-বাঁচি দশা। দাবার ৬৪ টি বর্গক্ষেত্রের প্রতিটিতে যদি আগের ঘরের দ্বিগুণ শস্য রাখতে হয় আর প্রথম ঘরে যদি একটিই শস্য থাকে, তাহলে মোট শস্যের পরিমাণ দাঁড়ায় (২^৬৪ - ১) – সোজা কথায় বললে, ৬৪ খানা ২ কে একে অপরের সঙ্গে গুণ করে তার থেকে এক বিয়োগ করা। কাগজকলমে তো হবে না, ক্যালকুলেটরে হিসেব করলে সংখ্যাটা দাঁড়াবে ১৮,৪৪৬,৭৪৪,০৭৩,৭০৯,৫৫১,৬১৫ ! শেরহামের ভাঁড়ার তো দূর, গোটা পৃথিবীতেই এত গম নেই।
গুনতি নেহাত পাতি নয়, যতই সে পাটিগণিত হোক।
....................
#pepsi #branding #Arithmatic