ব্যক্তিত্ব

চরণ ধরিতে ‘দিয়েগো’ আমারে

অর্পণ দাস Nov 27, 2020 at 8:34 am ব্যক্তিত্ব

খবরটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন করেছিলাম এক পরিচিত ফুটবল ভক্তকে। মারাদোনার মৃত্যু সংবাদ তাকে যথেষ্ট বিচলিত করেছে, তার চেয়েও বেশি করেছে চিন্তাগ্রস্ত। কী করে সে এই খবরটা তার অসুস্থ বাবাকে জানাবে! সেই অসুস্থ ব্যক্তি, যিনি সাদা-কালো টিভির পর্দায় দেখেছিলেন এক নীল-সাদা হরিণের দৌড়। যিনি তার যৌবনে এক যুবককে দেখে জেনেছিলেন মন্ত্রশক্তির মাহাত্ম্য। আর্জেন্টিনার পতাকার হলুদাভ সূর্যের আলোয় ভিজেছিলেন তিনি, তার মতো আরও হাজারো স্বপ্নালু বাঙালি। তার বাবা সেই হাজারো বাঙালির একজন, যাঁদের কাছে মারাদোনা সেই রাজপুত্রের নাম। আশ্চর্য! লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনায় সেই রাজপুত্রের মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গের একটা পরিবার চিন্তিত হয়ে ওঠে তাদের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যকে নিয়ে! এ তো শুধু ফুটবল নয়! এ তার চেয়েও বড়ো একটা খেলা।

যে খেলার নাম জীবন। সেই খেলার একক খেলোয়াড়ের নাম দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। তাঁর কোনো প্রতিযোগী নেই। নেই কোনো উত্তরসূরী। শুধু ‘একার কাঁধে’ দলকে জেতানোর নাম মারাদোনা নয়। মারাদোনা দারিদ্র, অর্থ, প্রতিবাদ, মাদক, মাফিয়া ও ফুটবলের এক বিরাট দুনিয়ার একচ্ছত্র সম্রাট। যিনি ফুটবলের থেকেও বড়ো। যিনি জীবনের থেকেও বড়ো। যিনি সপ্তাহে চারদিন চূড়ান্ত মাদক সেবনের পর জ্বলে ওঠেন নাপোলি ফুটবল ক্লাবের জার্সি গায়ে। যিনি রিক্ত ক্লাবের হাতে তুলে দেন দুবারের ‘সেরি এ’ খেতাব, একবার উয়েফা কাপের সাফল্য। যিনি স্ব-ঔরস জাত সন্তানকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। যিনি বিশ্বকাপের মঞ্চে গোল করে আগুনে মেজাজে এগিয়ে যান ক্যামেরার দিকে। এই তিনি ‘হ্যান্ড অফ গড’-এর গোলে কলঙ্কিত, এই আবার তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গোলটি করে বসেন। যিনি কোচিং জীবনে মাদকের নেশায় কথা হারিয়ে ফেলেন, যিনি ম্যাচ চলাকালীন রাজকীয় সিংহাসন পেতে বসে পড়েন সাইড লাইনে। তিনি প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের, তিনিই আবার ইরানের মৌলবাদী রাষ্ট্রপ্রধানকে সমর্থন করেন। হাতে চে গেভারার উল্কি, ফিদেল কাস্ত্রোর বন্ধু এই মানুষটির একসময় ওঠা-বসা ছিল ইতালির মাফিয়াকুলের সঙ্গে। ফুটবলীয় দক্ষতায় হয়তো অনেকেই তাঁর কাছাকাছি চলে আসবেন। কিন্তু জীবনের বর্ণচ্ছটায় যে-কোনো দিন দশ গোল মেরে দেবেন অন্য কোনো ক্রীড়াবিদকে। তিনি নিছক কোনো ফুটবলার নন; বিশৃঙ্খল, স্বেচ্ছাচারী এক ‘ডেমিগড’।

আমরা যারা নব্বইয়ের প্রজন্ম, তারা এই মারাদোনাকে সরাসরি দেখার সুযোগ পাইনি। রোনাল্ডিনহোর অনাবিল হাসি বা রোনাল্ডো ফেনোমেনোর চুলের ছাঁট দেখতে দেখতে আমরা ঢুকে পড়েছি মেসি-রোনাল্ডোর চূড়ান্ত পেশাদার ফুটবল বৃত্তে। কিন্তু যারা আশির দশকে দ্রুত পরিবর্তনশীল দুনিয়ার থেকে অনেক দূরে এই বাংলায় বসে মারাদোনাকে দেখেছেন, তাদের কাছে মারাদোনা আজও একটি মিথ। গ্লোবালাইজেশন-পূর্ব বাংলায় সদ্য আসা টেলিভিশন এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। তৃতীয় বিশ্বের একটা জাতি, ফুটবল যার কাছে পাগলামির অন্য নাম; সেই বাঙালিকে একটা বিরাট ফুটবল বিশ্বের সন্ধান দিলেন মারাদোনা। সে চোখ ভরে দেখল এই বেঁটেখাঁটো, শক্তপোক্ত যুবকের ফুটবল ঔদ্ধত্য। যাঁর বাঁ পায়ে যাদু, যাঁকে মারতে মারতে হারানো যায় না, যিনি অনায়াস দক্ষতায় কাটিয়ে যান বিপক্ষের ছ-সাত জন খেলোয়াড়কে। একবার এক মারাদোনা ভক্ত বলেছিলেন যে বাঙালির একটা নিজস্ব মারাদোনা আছে। একটা মারাদোনার ঝাঁকড়া চুল, মুখে সারল্যের হাসি, কাদা মাখা জার্সি; আরেকটা মারাদোনার মাঠে আর মাঠের বাইরে আবেগের বিস্ফোরণ, উদ্দাম জীবনযাত্রায়, স্পষ্ট বক্তায়। এ যেন বাঙালির ঘরের বখাটে ছোট ছেলেটা, যাকে ভালো না বেসেও উপায় নেই। হয়তো সেই কারণেই ইছাপুরের গঙ্গার পাড়ের জনৈক ভক্তের বাড়িটি আর্জেন্টিনার নীল-সাদা রঙে রেঙে ওঠে। উত্তর কলকাতার গলি জুড়ে আঁকা হয় মারাদোনার বিরাট পোস্টার। তাই মারাদোনা যখন কলকাতায় আসেন, তখন তাঁকে দেখতে জড়ো হয়ে যায় হাজারে হাজারে মানুষ। এই মারাদোনার সঙ্গে ফকল্যান্ড যুদ্ধের ইতিহাস কিংবা কোনো রাজনৈতিক যোগসূত্র খোঁজা নেহাতই কষ্টসাধ্য কল্পনা। কিন্তু মারাদোনা মানেই তো দুর্দম আবেগ, আকাশকুসুম কল্পনা। তা সে একবিংশ শতাব্দীর বাঙালির ভার্চুয়াল স্মৃতিচারণে হোক বা আশি-নব্বইয়ের বাঙালির চায়ের ঠেকে হোক। এরকম গল্পের পর গল্প জমতে জমতেই তিনি বাঙালির নিজস্ব ‘গ্লোবাল আইকন’-এ পরিণত হন।

রাত বাড়ছে। হেমন্তের পেলব শীত কুয়াশায় ঘনত্ব বাড়াচ্ছে। ওদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় আছড়ে পড়ছে শোকবার্তা। পেলে জানালেন, তিনি অপেক্ষা করছেন কবে দুই অসমবয়সী বন্ধু ফুটবল খেলবেন আকাশের নীল ময়দানে। রোনাল্ডিনহোর চোখে জল। বর্তমান-প্রাক্তন, দেশি-বিদেশি ফুটবলাররা বিদায় জানাচ্ছেন তাঁদের ‘আমিগো’-কে। চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচে নীরবতা পালন চলছে। ইতালির নেপলস শহরের মানুষ নেমে এসেছে রাস্তায়। নাপোলি ক্লাবের স্টেডিয়াম ‘সান পাওলো’ সারারাত আলো জ্বালিয়ে তাদের ফুটবল ঈশ্বরকে স্বর্গের পথ দেখাচ্ছে। আর্জেন্টিনার বুয়নেস আইরেস শহর স্বজন হারানোর যন্ত্রণায় কাঁদছে সারারাত। যেখানে অনেক চেনা মুখ। যাদেরকে আমি আগে দেখেছি ট্রেনে-বাসে, বাজারে-অফিসে, ফুটবল স্টেডিয়ামে। কাল সকালে হয়তো ভীড় বাড়াবে আরেকটা চেনা মুখ। আমার সেই বন্ধুর বাবাকে হয়তো দেখব একটা জার্সি হাতে কোনো রেলিং-এর গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। তাঁর চোখে জল। মৃত্যুর চোখে জল। তিনি শেষ বিদায় জানাতে এসেছেন তাঁর বন্ধুকে, তাঁর নায়ককে। বিদায় দিয়েগো। যাই বলতে নেই, বলো আসি।



#Diego Maradona #Death #Footballer #Argentina #দিয়েগো মারাদোনা #Hand of God #memoir #Respect #অর্পণ দাস #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

21

Unique Visitors

219136