বিনোদন

‘সুলোচনা’ নামে ভারতীয় ছায়াছবির নির্বাক যুগ কাঁপিয়েছিলেন ইহুদি-বংশজাত রুবি মায়ার্স

মৃণালিনী ঘোষাল Oct 2, 2020 at 5:10 am বিনোদন

প্যাক আপ (চতুর্থ পর্ব) :

''দেহপট সনে নট সকলি হারায়''। সময়ের চেয়ে বড় সুপারস্টার কেউ নেই। তার সামনে সবাই পকেট-সাইজ। সময় কারো রোয়াব দেখে না বেশিদিন। খ্যাতি? সে তো বালির বাঁধ। আজ যে রাজা, কাল সে ফকিরেরও ফকির। সত্যজিৎ রায়ের কোনও এক গল্পে একটি চরিত্র বলেছিল, অভিনেতারা আক্ষরিক অর্থেই 'শুটিং স্টার'। উল্কার মতো আসেন। উল্কার মতোই চলে যান। মানুষ অল্পেই মাথায় তুলে নাচে, তার চেয়েও অল্পে অবহেলাভরে মুখ ফিরিয়ে চলে যায় ক'দিন পর। বড় নিষ্ঠুর সেই গণ-প্রত্যাখ্যান। বড় অশ্লীল সেই গণ-বিস্মৃতি। বেঁচে থাকতে থাকতেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যান শতকরা নিরানব্বই ভাগ। বিরাট মাপের সুপারস্টারেরা মৃত্যুর পর দু' এক দশক অবধি টেনে দেন কোনওমতে। আসলে সময়ের চেয়ে বড় ঠগবাজ আর কে আছে! তার সাময়িক বশ্যতা- স্বীকারকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ভেবে নিলেই পিঠে ছুরি খেতে হয়। সিলি পয়েন্টের এই নতুন ফিচার-সিরিজে আমরা তুলে আনব পুরোনো দিনের এমন কিছু অভিনেতার গল্প, যাঁদের আমরা আজ পরিপাটি ভুলে গেছি - অথচ সময় একদিন তাঁদেরও তাঁবেদারি করেছে। প্রতি শুক্রবার সিলি পয়েন্টের ফিচার-সিরিজ 'প্যাক আপ'। আজ তৃতীয় পর্বে ভারতীয় চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগের 'স্টার' অভিনেত্রী রুবি মায়ার্স।


.............................................................................................................





সিনেমা চাই। সিনেমায় ভরপুর বিনোদনও চাই। ফলে মহিলা অভিনেতাও চাই। কিন্তু নিজেদের ঘরের মেয়েদের তো তা বলে ‘নামতে’ দেওয়া যাবে না সিনেমায়। এমনই মনোভাব ছিল গত শতাব্দীর দুই বা তিনের দশকের সাধারণ ভারতীয় হিন্দু বা মুসলিম সমাজের। সেলুলয়েডের সেই শৈশবে এমন ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ পরিস্থিতিতে পরিচালকদের ভরসা ছিলেন ইহুদি সম্প্রদায়-জাত মহিলারা। অন্তত দুটো দশক ধরে 'প্রমীলা', 'সুলোচনা', 'ফিরোজা বেগম' ইত্যাদি ভারতীয় স্ক্রিন-নাম নিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র-জগৎ শাসন করেছেন ইহুদি অভিনেত্রীরা। প্রমীলার আসল নাম ছিল এস্থার আব্রাহাম। ফিরোজা বেগমের আসল নাম সুসান সলোমন। তবে এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় তারকা ছিলেন সুলোচনা, যার আসল নাম রুবি মায়ার্স। ভারতীয় সিনেমার নির্বাক যুগের শেষ দেড় দশক তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বেশি উপার্জনকারী অভিনেত্রী।

১৯০৭ সালে পুনে শহরে রুবির জন্ম। প্রথম জীবনে পেশায় ছিলেন টেলিফোন অপারেটর। কালো চুল আর বাদামি চোখের রুবিকে প্রথম অভিনয়ের অফার দিয়েছিলেন কোহিনূর প্রোডাকশন কোম্পানির মোহন ভবানী। মোহন ভবানীর পরিচালনাতেই ‘সুলোচনা’ নামে নির্বাক যুগের ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় ‘ফিমেল স্টার’ হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর প্রথম ছবি ‘সিনেমা কুইন’ মুক্তি পায় ১৯২৬ সালে। নির্বাক যুগে তাঁর অভিনীত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ছবিগুলি হল টাইপিস্ট গার্ল (১৯২৬), বলিদান (১৯২৭), মাধুরী (১৯২৮), আনারকলি (১৯২৮), ইন্দিরা বি.এ. (১৯২৯) ইত্যাদি। ১৯২৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ওয়াইল্ড ক্যাট অব বম্বে’ ছবিতে আট রকম ছদ্মবেশ নিয়ে অভিনয় করেছিলেন তিনি। টেকনিকের সেই আদিযুগে এইরকম ঝুঁকি নিতে প্রথম সারির ক’জন নায়িকা রাজি হতেন, সন্দেহ। কোহিনূরের পর তিনি ইম্পিরিয়াল কোম্পানির সঙ্গে মাসিক চুক্তিতে আবদ্ধ হন, যারা সেই যুগে তাঁকে মাসিক ৫০০০ টাকা বেতন দিত। অভিজাত অটোমোবাইল কোম্পানি শেভ্রোলের সবচেয়ে দামি মডেলের গাড়ি ব্যবহার করতেন সুলোচনা।


এরই মধ্যে ফিল্মের ইতিহাসে ঘটে গেল এক যুগবদল। তিনের দশকের গোড়ার দিকে সেলুলয়েড সবাক যুগে এসে পড়ার পর শুরুতে সুলোচনার কেরিয়ার কিছুটা সমস্যায় পড়েছিল, কারণ তিনি হিন্দি বলায় একেবারেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। কিন্তু একটা বছর অভিনয় থেকে ছুটি নিয়ে দারুণ উদ্যমে হিন্দি শিখে নিয়ে তিনি প্রবলভাবে ফিরে এলেন ‘মাধুরী’ ছবির সবাক সংস্করণ নিয়ে। পরপর তাঁর সমস্ত সফল নির্বাক ছবির সবাক সংস্করণ মুক্তি পেল এবং দারুণ হিট করল। বেশিরভাগ সিনেমায় সুলোচনার সঙ্গে বিপরীতে ছিলেন সে সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় পুরুষ-তারকা ডি. বিলিমোরিয়া। বিলিমোরিয়ার সঙ্গে সুলোচনার জুটি গোটা তিনের দশক বলিউডকে শাসন করেছে। পর্দায় তাঁদের ঘনিষ্ঠ চুম্বন-দৃশ্য ভিক্টোরীয় সমাজ-রুচিতে একইসঙ্গে বিতর্ক ও নিষিদ্ধ শিহরণের ঢেউ তুলেছিল। তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়েও কিছু কানাঘুষো শোনা যায়। বিতর্কিত ও মুখরোচক নানা গুজব ডানা মেলেছে সুলোচনার ব্যক্তি-জীবন নিয়ে। এ সময় তিনি ‘রুবি পিকচারস’ নামে নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থাও খোলেন। অবশ্য সে উদ্যোগ বেশিদিন সাফল্য পায়নি।


চারের দশকের শুরু থেকে সুলোচনার কেরিয়ার-গ্রাফ নিচের দিকে নামতে থাকে। নতুন দক্ষ অভিনেত্রীরা ততদিনে ফিল্মে আসতে শুরু করেছেন। নায়িকা হিসেবে আর বক্স অফিসে পাত্তা পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে তিনি ‘ক্যারেক্টার রোল’-এর দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন। এরপর অনেক ছবি করলেও তাঁর সুসময় আর ফিরে আসেনি। আস্তে আস্তে অপাংক্তেয় হতে হতে অনেক অকিঞ্চিৎকর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। চারের দশকে জুগনু (১৯৪৭) বা শায়র (১৯৪৯)-এর পর তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবির সংখ্যা হাতেগোনা। ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘খাট্টা মিঠা’-ই সম্ভবত তাঁর অভিনীত শেষ ছবি। ভারতীয় চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ১৯৭৩ সালে তাঁকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। কিন্তু তাঁর আর্থিক অবস্থার খোঁজ নেবার মতো কেউ ছিল না। শোনা যায়, ভারতীয় সিনেমার নির্বাক যুগের শেষ সম্রাজ্ঞী নাকি শেষদিকে নিজের ফ্ল্যাটের ভাড়াটুকুও নিয়মিত দিতে পারতেন না। ১৯৮৩ সালে, প্রায় সম্বলহীন অবস্থায় মুম্বইয়ে নিজের ফ্ল্যাটেই মারা যান তিনি। ২০১৩ সালে ভারতীয় ডাক বিভাগ তাঁকে স্মরণ করে একটি স্ট্যাম্প প্রকাশ করেছে।

[কভার পোস্টার : অর্পণ দাস]


#Ruby Myers # Sulochana # Indian silent film actress #Silent Era #Indian Films #Jewish #Jewish ancestry # Dada Saheb Phalke Award # D. Billimoria #Wildcat of Bombay #Typist Girl # Kohinoor Film Company #Anarkali #Cinema Queen #রুবি মায়ার্স #সুলোচনা #নির্বাক চলচ্চিত্র #নির্বাক যুগ #অভিনেত্রী

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

69

Unique Visitors

182717