খেলা

স্মৃতির রিজার্ভ বেঞ্চ (দ্বিতীয় কিস্তি) : সুধীর সাহা

অলর্ক বড়াল Aug 1, 2020 at 5:32 am খেলা

আধুনিক দুনিয়ায় খেলা বরাবরই সবচেয়ে গ্ল্যামারাস জিনিসগুলোর একটা।
সব খেলা নয় অবশ্যই। এ দুনিয়ায় কোনও কোনও খেলা ধর্মের সমার্থক হয়ে যায়, আর কোনও কোনও খেলার কুশীলবেরা স্বীকৃতি না পেয়েই চলে যান - চুপিচুপি, একা একা। তবে স্মৃতি জিনিসটা বড় প্রতারক। আজকের গ্ল্যামার নিমেষে ফিকে হয়ে যায় আগামীর ধুলো পড়ে। একটু পুরোনো হয়ে গেলেই প্রায় সব স্মৃতি এক পংক্তিতে বসে যায়। ভুস করে তাদের মুখে ধোঁয়া ছেড়ে এগিয়ে যায় আমাদের বাস। স্মৃতি খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে রিনিউ করতে করতে ডিলিট করতে থাকে পুরোনো জিনিসপত্র। এই তথ্যবিপ্লবের যুগে কিছুদিন আগের ঘটনাই যেন মনে হয় কত শতাব্দী পিছনে ফেলে আসা - সেপিয়া টোনে ছোপানো মনকেমন। বেহালার আগেও তো অনেক গর্ব করার মতো গল্প ছিল বাঙালির খেলায়। পঙ্কজ রায়েরও আগে ছিল কিছু গল্প। এমনকী কিছু গল্প ছিল সেই সাদা- কালো যুগের গোবরবাবুরও আগে। আমরা খবর রাখি না। কেমন হয় যদি ধুলো- টুলো ঝেড়ে তুলে আনা যায় পুরোনো দিনের এমন কয়েকজন বিস্মৃতপ্রায় ক্রীড়াব্যক্তিত্বের গল্প?
সিলি পয়েন্টের এই নতুন সিরিজে সেই চেষ্টাই ধরা থাকল, খেলা-প্রেমীদের জন্য। আজ দ্বিতীয় কিস্তিতে কুস্তিগির সুধীর সাহা।

প্রথম যুগের বাঙালি কুস্তিগীরদের মধ্যে প্রথমেই উঠে আসে যতীন্দ্রচরণ গুহর নাম, যিনি ‘গোবর গুহ’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাঙালী হিন্দু সমাজে কুস্তিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন এবং ভারতীয় কুস্তিকে বিশ্ব-দরবারে সসম্মানে তুলে এনেছিলেন। গোবর গুহর এহেন জনপ্রিয়তার আড়ালে পড়ে গেছিলেন আরেক বাঙালি কুস্তিগীর সুধীর সাহা। সুধীর খেলোয়াড় হওয়ার পাশাপাশি কোচ, কুস্তি প্রশাসক ও রেফারি হিসেবেও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি লাভ করেন। তাঁর সর্বোত্তম কীর্তি হল ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম কুস্তির ‘গ্রেকো-রোমান’ ধরনের প্রবর্তন করা।

ছয় বছর বয়সে বাবা নন্দলাল সাহার কাছে কুস্তিতে হাতেখড়ি সুধীর সাহার, পরবর্তীতে তিনি উস্তাদ মাজিদ পালোয়ানের কাছে কুস্তির প্রশিক্ষণ নেন। ফ্রিস্টাইল বিভাগে তিনি টানা ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত বাংলার রাজ্য কুস্তি প্রতিযোগিতা জেতেন। জাতীয় কুস্তি প্রতিযোগিতায় মিডলওয়েট বিভাগে ১৯৪০ সালে তিনি প্রথম হন। খেলোয়াড়জীবন শেষ করার পর তিনি কোচিং ও রেফারিং-এ মনোনিবেশ করেন।

১৯৪৮-এর লন্ডন অলিম্পিকে তাঁর দুই ছাত্র কে. পি. রায় ও নির্মল বোস ভারতের হয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। চার বছর পর, ১৯৫২-এ তাঁরই তত্ত্বাবধানে ভারতের হেলসিঙ্কি অলিম্পিকের কুস্তি বিভাগের খেলোয়াড়েরা কলকাতার জোড়াবাগান অঞ্চলের পঞ্চানন ব্যায়াম সমিতিতে প্রস্তুতি ক্যাম্প করেছিলেন। ঐ প্রতিযোগিতায় সুধীরের অন্যতম শিক্ষার্থী কে.ডি.যাদব বান্টামওয়েট বিভাগে ব্রোঞ্জ পদক জয় করেন যা স্বাধীন ভারতের প্রথম ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রাপ্ত অলিম্পিক পদক।

১৯৫৭ সালে তিনি প্যারিসে ‘ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ অ্যাসোসিয়েটেড রেসলিং স্টাইলস্’ আয়োজিত প্রথম রেফারি ও টেকনিক্যাল অফিশিয়ালদের সভায় যোগদান করেন এবং তাঁর আন্তর্জাতিক রেফারিঙের লাইসেন্স লাভ করেন। সুধীর সাহা তাঁর বিস্তৃত রেফারিং কেরিয়ারে পনেরশোর অধিক কুস্তি ম্যাচে অফিশিয়ালের ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৬৪-এর টোকিয়ো অলিম্পিকে তিনি রেফারি হিসেবে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এছাড়াও তিনি ১৯৬১ সালে ইয়োকোহামায় ও ১৯৬৭ সালে দিল্লিতে আয়োজিত বিশ্ব-কুস্তি-প্রতিযোগিতা এবং ১৯৬৬ সালের কিংস্টোন কমনওয়েলথ গেমসে রেফারির দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৬১-তে জাপান থেকে আন্তর্জাতিক কোচিং ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি জাতীয় দলের প্রশিক্ষকরূপে বহু আন্তর্জাতিক সাফল্যের অধিকারী হন। তাঁরই প্রশিক্ষণে ১৯৬২ এশিয়ান গেমসে কুস্তিতে ভারতীয় কুস্তিগীরেরা তিনটি স্বর্ণপদকসহ মোট বারোটি পদক জয় করেন। ১৯৬৬-এর কমনওয়েলথ গেমসে অংশগ্রহণকারী সাতজন কুস্তিগীরের প্রত্যেকেই পদক জয় করেন, পাশাপাশি ভারত কুস্তির দলগত ইভেন্টেও জয়লাভ করে।

দক্ষ খেলোয়াড়, প্রশিক্ষক ও রেফারি হওয়ার পাশাপাশি তিনি প্রশাসক হিসেবেও অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কুস্তি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক, ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের যুগ্ম-সম্পাদক ও উপ-সভাপতি, ভারতীয় রেফারি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান, নির্বাচক কমিটির সদস্যের মত গুরুত্বপূর্ণ পদগুলির দায়িত্ব তিনি যথাযথভাবে সামলেছেন। তাঁরই তত্ত্বাবধানে ভারতের মাটিতে প্রথমবারের জন্য গ্রেকো-রোমান স্টাইলের কুস্তি প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয় কলকাতার পঞ্চানন ব্যায়াম সমিতিতে। ১৯৬৫ সালে সুধীর সাহার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জাতীয় কুস্তি প্রতিযোগিতায় গ্রেকো-রোমান স্টাইল প্রবর্তিত হয় ।




কভার পোস্টার ডিজাইন : অর্পণ দাস

#

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

39

Unique Visitors

177697