নিবন্ধ

সমকাল ও জগদীশচন্দ্র: প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ (পঞ্চম পর্ব)

অর্পণ পাল Jan 20, 2021 at 5:02 am নিবন্ধ

.......................................

অবলা বসু ও রবীন্দ্রনাথ: সম্পর্কের উত্থানপতন (প্রথম কিস্তি)
................................................


‘বন্ধুজায়াকে আমার নববর্ষের সাদর অভিবাদন জানাইবে। শুনিলাম, তিনি অন্নপূর্ণা মূর্ত্তিতে প্রবাসী বাঙ্গালীকে মাছের ঝোল ভাত খাওয়াইয়া পুণ্য লাভ করিতেছেন— তাঁহার মাছের ঝোলের স্বাদ এখনও ভুলি নাই।’ 
১৯০১-এর মে মাসে এই চিঠি যখন লিখছেন রবীন্দ্রনাথ, ততদিনে দু-তিনটি জায়গায় একাধিক বছর ভাড়া থাকবার পর জগদীশচন্দ্র বসু রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের পাশে তাঁর নিজস্ব বাড়ি নির্মাণ করে সেখানে বসবাস শুরু করেছেন। তবে সেই সময়টায় তিনি আছেন ইউরোপে, দ্বিতীয় বৈজ্ঞানিক মিশনে। একাধিক দেশে বক্তৃতা, এবং নতুন গবেষণা-দিগন্ত উন্মোচনে মেতে আছেন তিনি। দেশে ফেরা ক্রমশ বিলম্বিত হচ্ছে তাঁর। 
নিজস্ব স্থায়ী এই বাড়িতে তো বটেই, এর আগে যে দুটি বাড়িতে জগদীশচন্দ্র ভাড়া থাকতেন, সে ঠিকানাগুলিতেও পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের পদছাপ। ১৮৯৭ সালের এপ্রিল মাসে প্রথম বৈজ্ঞানিক সফরের পরে কলকাতায় ফিরলে বিজ্ঞানীপ্রবরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের হৃদ্যতা গড়ে ওঠে, মোটামুটি তখন থেকেই জগদীশচন্দ্রের বাসায় রবীন্দ্রনাথ প্রায় প্রতিদিনই বিকেল বা সন্ধেবেলায় আড্ডা দিতে যেতে শুরু করেন। আর এই আড্ডায়, নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, উপস্থিত থাকতেন জগদীশপত্নী অবলা দেবী। বিশিষ্ট ব্রাহ্মনেতা দুর্গামোহন দাসের মেজ কন্যা, শিক্ষিতা, মার্জিত রুচিসম্পন্ন এই নারী এবং তাঁর বিশ্বখ্যাত স্বামীর সঙ্গসুখ রবীন্দ্রনাথ উপভোগ করতেন যথেষ্টই। অবলা দেবী, যিনি পরবর্তীকালে লেডি অবলা বসু নামেই বিশেষভাবে খ্যাত হন; তাঁর জীবনের দীর্ঘ যাত্রাপথে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নানা বিচিত্র পরিস্থিতিতে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন বিভিন্ন সময়ে, আর সেই সব ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে বিশ শতকের এক বিশেষ পর্বের আখ্যান। 
অবলা বসুর রান্নার সুখ্যাতি আবার মে মাসের ২১ তারিখের চিঠিতে। তখন জগদীশচন্দ্র সস্ত্রীক রয়েছেন প্রবাসে। ‘আমার ভারী ইচ্ছা করচে আমরা জন দুই তিনে মিলে তোমার ওখানে মাছের ঝোল খেয়ে আগুনের কাছে ঘরের কোণে ঘণ্টা দুই তিনের জন্যে জমিয়ে বসি।’ মাছের ঝোলের স্মৃতি ফের রবীন্দ্রনাথের মনে জেগে ওঠে ১৯০১-এর সেপ্টেম্বরে বন্ধুকে চিঠি লেখবার সময়— ‘তোমার সার্ক্যুলর রোডের সেই ক্ষুদ্র কক্ষটি এবং নীচের তলায় মাছের ঝোলের আস্বাদন সর্বদাই মনে পড়ে।’ শুধু রান্না করা খাদ্যদ্রব্যের স্মৃতিই নয়, রবীন্দ্রনাথের মনে জেগে থাকত বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর সঙ্গমুহূর্তগুলিও। একত্রে খোলা বারান্দায় বসে আড্ডা, গান বা রাতের খাবার খেয়ে যাওয়া— সব মিলিয়েই তো সুখস্মৃতি তৈরি হয়। আর যা মাঝেমাঝেই ফিরে ফিরে আসে তাঁর লেখায়, চিন্তায় বা অবচেতন মনে। 
অবলা দেবী বা জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ আলাপের আগে থেকেই দুর্গামোহন দাসের পরিবারের অন্য সদস্যদের চিনতেন রবীন্দ্রনাথ। প্রথমত, ঠাকুরবাড়ি আর দাস-পরিবার— দুটিই ব্রাহ্মসমাজভুক্ত এবং আলোকপ্রাপ্ত; আর দ্বিতীয়ত, দুর্গামোহনের জ্যেষ্ঠা কন্যা সরলা দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রতিষ্ঠা করা ‘সখিসমিতি’র সদস্য। এই সংস্থা, নামেই স্পষ্ট, জড়িত থাকত নানারকম মহিলাকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে, যার মাধ্যমে ব্রাহ্মসমাজের মহিলাদের মধ্যে গড়ে উঠত একটা আত্মিক যোগাযোগ। সরলা দেবীর অনুরোধেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর ‘মায়ার খেলা’ চিত্রনাট্য। যে জন্য ১৮৮৮ সালে এই নাটকটি প্রকাশিত হলে তিনি সেই ‘শ্রীমতী সরলা রায়’কেই উৎসর্গ করেন। 
সরলা দেবীর স্বামী প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক ডঃ প্রসন্নকুমার রায়ের সঙ্গেও আন্তরিক সম্পর্ক ছিল রবীন্দ্রনাথের। তবে অবলা দেবীর সঙ্গে কবির যে সরাসরি যোগাযোগ ছিল ১৮৯৭ সালের আগে, তেমনটা প্রমাণিত হওয়ার কারণ এখনও দেখিনি আমরা। তবে ঠাকুরবাড়ির অন্য কয়েকজন সদস্যের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল বসু বা দাস পরিবারের, যেমন স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবী (চৌধুরাণী)-র সঙ্গে একই স্কুলে পড়তেন জগদীশচন্দ্রের এক বোন হেমপ্রভা আর দুর্গামোহন দাসের কনিষ্ঠা কন্যা শৈলবালা, ওরফে খুসী। অন্য কারও বাড়িতে গিয়ে থাকবার অনুমতি না পেলেও একমাত্র দুর্গামোহনবাবুর বাড়ি হলে সেটা পেতেন সরলা দেবী, জানিয়েছেন স্মৃতিকথা ‘জীবনের ঝরাপাতা’য়। 
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অবলা দেবীর সেই প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপিত হল ১৮৯৭ সালের এপ্রিল মাসে, বিজ্ঞানী-দম্পতির বিদেশ প্রত্যাবর্তনের পর। পরবর্তী দু-তিন বছর রবীন্দ্রনাথ যেমন কলকাতায় থাকলে নিয়মিত আসতেন জগদীশচন্দ্রের বাসায়, তেমনই প্রায় প্রতি সপ্তাতেই সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্র রওনা দিতেন শিলাইদহের উদ্দেশ্যে, সপ্তাহান্তের দুটো দিন বাংলার গ্রামীণ বিশুদ্ধ বাতাস প্রাণভরে নিয়ে তাজা হয়ে সোমবার ফিরে আসতেন কলেজে ক্লাস নেওয়ার জন্য। 
১৮৯৮ সালের পর জগদীশচন্দ্রের জীবনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যেতে থাকে— দ্বিতীয় বৈজ্ঞানিক সফরে বিদেশগমন, ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে আলাপ ও পরিচয়, স্বামীজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, গবেষণার ধারা পরিবর্তন ইত্যাদি নানা ব্যাপার; তবে সেসব এড়িয়ে আপাতত আমরা চলে আসি ১৯০২ সালে। তখনও বসুদম্পতি আছেন লন্ডনে, আর জগদীশচন্দ্র সংগ্রাম করে চলেছেন তাঁর নতুন অভিনব বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে সে দেশের বিজ্ঞানীমহলে প্রতিষ্ঠা করবার বাসনায়। এইরকম একটা সময়ে অবলা দেবী আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও সমান্তরালভাবে চলেছে চিঠিপত্রের আদানপ্রদান। সেরকম একটি চিঠিতে আমরা শুরুতেই দেখি অবলা দেবী লিখছেন, ‘অনেক সময় আপনাকে চিঠি লিখিতে ইচ্ছা হইয়াছে কিন্তু সময়াভাবে সেই ইচ্ছা কার্য্যে পরিণত করিতে পারি নাই।’(২৭ মার্চ ১৯০২ তারিখের চিঠি)
এই চিঠির যে উত্তর, সেখানে রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ্যেই ব্যক্ত করেন চিঠি পেয়ে তাঁর আনন্দের কথা, সেই সঙ্গে ইচ্ছাপ্রকাশ, ‘ক্ষণে ক্ষণে আমার কেবলই ইচ্ছা হয় আপনাদের দেখিয়া আসি।’  
এইসময় রবীন্দ্রনাথ বোলপুরে তাঁদের শান্তিনিকেতন বাড়িটিকে কেন্দ্র করে একটি ব্রহ্মচর্যাশ্রম বানিয়ে গুটিকয়েক ছাত্র আর শিক্ষক নিয়ে এক প্রাচীন যুগের মতো শিক্ষাকেন্দ্র চালাবার সাধনায় রত আছেন। তাঁর এইসময়কার চিঠিপত্রে তাই শান্তিনিকেতনের এই বিদ্যালয়েরই নানা প্রসঙ্গ। আর বছরকয়েক পরে যে বিদ্যালয় নিয়েই তাঁদের মধ্যে ঘটবে এক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। 


১৯০২ এর অক্টোবর মাসে যখন মৃণালিনী দেবী মৃত্যুশয্যায়, তখনও বন্ধুদের দেশে ফেরবার খবর পেয়ে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং গিয়েছেন হাওড়া স্টেশনে, তাঁদের অভ্যর্থনা জানাতে। এরপর নভেম্বর মাসের ২৩ তারিখে দুরারোগ্য অসুখে ভুগে মৃত্যুবরণ করলেন রবীন্দ্র-পত্নী, মাত্র আটাশ বছর বয়সে। শোকসন্তপ্ত কবি এর পরে বেশ কয়েকবার গিয়েছেন বন্ধুর কাছে, গল্পগুজব করে বা বিদেশের অভিজ্ঞতার কথা শুনে পত্নীর মৃত্যুশোকের ক্ষতে কিঞ্চিৎ উপশম নিশ্চয়ই দিতে পেরেছিলেন তিনি। 
তখন বসুদম্পতি রয়েছেন রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের পাশে তাঁদের নিজস্ব বাড়িতে। তিনতলা এই বাড়িটি তাঁদের একান্ত আপন জায়গা। একেবারে ওপরের তলায় জগদীশচন্দ্রের গবেষণাকক্ষ, লাইব্রেরি আর পাঠকক্ষ। দোতলায় অন্দরমহল। আর একতলায় ড্রয়িং রুম। রবীন্দ্রনাথ যখন আসেন, সোজা চলে যান তিন তলায়। আর দোতলা থেকে অবলা দেবী নিয়ে আসেন নানাবিধ সুখাদ্য। তারপরে তিনজনে চলে আড্ডা। 
তবে তখনও তাঁরা জানেন না, আর মাস কয়েক পরে জগদীশ-দম্পতির জীবনেও আসতে চলেছে এক দারুণ আঘাত। 

(ক্রমশ) 
....................................... 

[পোস্টার - অর্পণ দাস] 
#জগদীশচন্দ্র বসু #রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর #অবলা বসু #মৃণালিনী দেবী #দুর্গামোহন দাস #সরলা রায় #ভগিনী নিবেদিতা #নিবন্ধ সিরিজ #Series #Jagadish chandra Bose #Rabindranath Thakur #Lady Abala Basu #অর্পণ পাল #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

52

Unique Visitors

177633