ভ্রমণ

বারাণসীর পথে-ঘাটে

শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী Aug 14, 2022 at 7:22 am ভ্রমণ

“ফেলু মিত্তিরের বলা তেত্রিশ কোটি দেবতার কথা জানি না, তবে ষাঁড় যে তার চেয়ে নেহাৎ কম হবে না, বেশ বুঝছি”, সায়নদীপ বলে। অটোর মৃদু ঝাঁকুনি খেতে খেতে, শহরের প্রতিটা মোড়ে থামতে থামতে আমরা চলেছি বারাণসী ষ্টেশন থেকে গঙ্গার দিকে। ২০২০-র ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু, চিনা-ভাইরাস কখন ভারতে ঢুকে পড়বে ঠিক নেই; কাজেই বেঁচে বর্তে আছি যদ্দিন, ঘুরে আসা যাক – এই মর্মে আমরা দুই বন্ধু দিন তিনেকের ঝটিতি সফরে এসেছি এই আদ্দিকালের শহরে। ধুলো-ধোঁয়ায় জর্জরিত পথঘাট শীতের শেষে, তাতে মানুষের ঢল বোধ হয় সারাবছরই; আর পথপ্রান্ত থেকে শুরু করে মাঝরাস্তায়, মায় পুলিশ কিয়স্কেও ষাঁড় এলিয়ে আছে অনন্তশয্যার ভঙ্গিমায়।

সোনারপুরা মোড়ে এসে অটো দাঁড়ায়। রফা হয়েছিল দেড়শ টাকায়, তবে কলকাতার মতোই ‘আর কুড়িটা টাকা বেশি’ দিয়ে নামতে হল। একদম চারমাথার মোড়ের একমাথাতেই দুর্গা গেস্ট হাউজ – কলকাতা থেকে ফোন মারফৎ যোগাযোগ করে বুকিং সেরেছিলাম। আগে থেকে চেনা, এমন নয়; তবে ঘাটের একদম কাছে, মোটামুটি কম দামে দুই ব্যাচেলরের দু’রাত্তির কাটিয়ে দেওয়ার ঠেক হিসেবে যথার্থ মনে হয়েছিল। গেস্ট হাউজের পাশ দিয়ে যে রাস্তা সরু হয়ে ঢুকে গেছে, তা ধরে মাত্র এক মিনিট হাঁটলেই হরিশচন্দ্র ঘাট। বারাণসীর দুই বিখ্যাত শ্মশানঘাটের একটি, কাজেই সকাল-দুপুর-রাতবিরেতে ‘রাম নাম সত্য হ্যাঁয়’-এর আনাগোনা লেগেই আছে। চারতলায় ১০০০ টাকায় পাওয়া মাঝারি সাইজের, শহরের সঙ্গে সাযুজ্য রাখা একটু অগোছালো একটা ঘরে মালপত্র রেখে লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়াই। নিচে শহরের গ্যাঞ্জাম, হট্টগোল; আবার রাতেই হয়তো এই সব শান্ত হয়ে কেবল শ্মশানবন্ধুদের কণ্ঠ পড়ে থাকবে। সায়নদীপ বলে, “বারাণসীর একটা অডিওস্কেপ তৈরি করতে পারলে মন্দ হয় না।”

রামনগর কেল্লার বারান্দা থেকে গঙ্গা 

সেদিনই দুপুরের খাওয়া সেরে আবার একটা অটো ভাড়া করে আমরা চলে যাই গঙ্গার ওপারে রামনগর কেল্লায়, মিনিট চল্লিশের পথ। বারাণসীর পথেঘাটে যে প্রাচীনতার গন্ধ লেগে থাকে, সেই গন্ধ কিছুটা রাজকীয় আভিজাত্য মাখিয়ে পরিবেশন করে কেল্লার অস্ত্র ও গাড়ির এক মিউজিয়াম। টিকিট কেটে প্রায় দু’ ঘণ্টা ধরে পুরনো গাড়ি, ঘোড়ার কোচ (বড় ধুলো-ধূসরিত, সঠিক সংরক্ষণের অভাবে) আর দোতলায় অস্ত্রাগার চাক্ষুষ করে কেল্লার এক বিরাট ফাঁকা ঘরের শেষপ্রান্তে পাই একটু নিচে নেমে যাওয়া স্বল্পদৈর্ঘ্যের সুড়ঙ্গ; কৌতূহলী হয়ে সে পথে নেমে একটু এগিয়েই আমরা উঠে আসি কেল্লার পিছনের দিকের খোলা ছাদে। বিকেলের অস্তগামী সূর্যের মুখে সে এক দৃশ্য! নিচে প্রবহমান গঙ্গার সবুজ জল, তিরতিরে ঢেউ সূর্যের কমলা রঙ মেখে আছে। ছাদে অবস্থিত ছোটো শিবমন্দিরের পাশে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি আমরা – মিউজিয়ামের ইতিহাস পেরিয়ে, সুড়ঙ্গ পেরিয়ে আচমকাই আকাশ ও নদীর এই বিশালতাকে দেখা নিঃসন্দেহে রামনগরে আমাদের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। 

সন্ধের মুখেই ফিরে আসি বারাণসীতে – অটো ছাড়লাম একেবারে দশাশ্বমেধ ঘাটে। আরতি দেখার ভিড় জমে উঠেছে ঘাটের সিঁড়িতে, আর তার মুখোমুখি, গঙ্গার নৌকায়। পাশাপাশি দুই ঘাট – দশাশ্বমেধ আর রাজেন্দ্রপ্রসাদে খুব বড় আয়োজন করে আরতি হয় – লোকে লোকারণ্য, আলো, মাইক সবের বন্দোবস্ত করে। কাজেই, প্রবল ভিড়ে দশাশ্বমেধের আরতি দেখার সৌভাগ্য কারুর না হলে, কিঞ্চিৎ স্থানমাহাত্ম্য ভুলে রাজেন্দ্রপ্রসাদ ঘাটে গেলেও একইরকম দৃষ্টিনন্দন আরতি দেখা যায়; এমনকি, দশাশ্বমেধের চেয়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদ ঘাট আরও অনেকটা বড় বলে স্থানসংকুলানেও তেমন একটা অসুবিধে হয় না। কিন্তু হায়! এখন ভাবলে মনে হয়, প্রতি সন্ধ্যার সেই আনন্দঘন উদযাপনে মানুষের ভিড় আবার কবে হবে কে জানে, বর্তমান অতিমারী পেরিয়ে! 

রাজেন্দ্রপ্রসাদ ঘাটের গঙ্গা আরতি 

আরতিশেষে ভিড়, গুঞ্জন পেরিয়ে সন্ধের নির্জন হয়ে আসা অন্যান্য ঘাটগুলো পেরিয়ে আমরা এগিয়ে যাই ধীর পায়ে। কোনও ঘাটে বসে স্থানীয় কোনও যুবক বাঁশি বাজায়, কোনও ঘাটে এক বিদেশী যুগল মাথার উপরের ইলেকট্রিক বাতির মৃদু হলুদ আলোয় উলটেপালটে দেখে তাদের সদ্য কেনা ‘ইন্ডিয়ান আর্ট’-এর উপর বইটি। ঘাটের মাথায় চাদরের মতো বিছিয়ে থাকে শেষ শীতের নরম কুয়াশা, গঙ্গাজল অলস ভাবে এসে লাগে পাথরের সিঁড়িতে, ছলাৎছল। ললিতা ঘাট আসতেই খেয়াল করি, বিরাট গম্বুজের এক ধার দিয়ে থরে থরে সাজিয়ে রাখা কাঠ; বুঝতে সামান্য দেরি হলেও আর সন্দেহ থাকে না যখন ওই গম্বুজের আড়ালে থাকা পাশের ঘাট থেকে নাকে এসে লাগে দাহের গন্ধ, কয়েক পা এগোলে গায়ে পাওয়া যায় আগুনের আঁচ। মণিকর্ণিকা – জীবন্মৃত মানুষে ভরে থাকা অনাদি সেই শ্মশানঘাট। মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিষাদপালনের সময় নেই মণিকর্ণিকার; একসঙ্গে তেরোটা চিতার লেলিহান শিখার জ্বলে ওঠা আমরা দেখি স্তম্ভিত হয়ে, পাশে দাঁড়িয়ে মৃতের পরিজন ও ডোমেরা কর্মব্যস্ততায় মগ্ন।

দ্বিতীয় দিন কেটে যায় চোখের নিমেষে। ভোজনরসিক দুই বন্ধুতে মিলে সকাল-সকাল বেরিয়ে পড়ি ‘ফুড ওয়াক’-এ, পায়ে হেঁটে খুঁজে বার করি কচোড়ি গলি – সেখানে পুর ভরা খাস্তা কচুরি আর চাটনি সহযোগে নাস্তা সেরে হেঁটে যাই মানমন্দিরে। যেতে যেতে দেখি, সরু গলির মাঝে আদ্দিকালের এক লাল বাড়ির গায়ে ঝোলানো রং করে কেটেকুটে টব বানানো পুরনো প্লাস্টিকের বোতল, তা থেকে ছোট্ট হলুদ ফুলগাছ বেরিয়ে আলো করে আছে চারদিক। হাতের ক্যামেরা বন্ধ রেখে শুধু বুকের খাঁচায় প্রাচীনতার মাঝে প্রাণের এই স্পন্দন অনুভব করি। কানে একটা আওয়াজ ভেসে আসে। গুঞ্জন। ঘাটের পাশে কোনো এক ঘুপচি, সূর্যের আলো না ঢোকা বাড়িতে সকালবেলা গুরু-শিষ্যদের টোল বসেছে। কচিকাঁচারা গুনগুন করে একজোটে সংস্কৃত শ্লোক পাঠ করছে। 

বিশ্বনাথের গলির রাবড়ি 


কল্যাণের দোকানের চা 

আমাদের গেস্ট হাউজেরই একতলায় অশোক রেস্তোরাঁয় দু’ বেলা ভরপেট চাপাটি, ডাল, সবজি আর দই পাওয়া যায় – সে খেয়ে দিব্যি কেটে যায় দিন। তাও, চোখের খিদে মেটাতে যাই অনিলের জর্দার দোকানে, নানারকম কড়া মশলা চেখে দেখি। গোধূলিয়ার মোড় থেকে দশাশ্বমেধকে ডানহাতে রেখে সোজা এগোলে ‘ক্ষীর সাগর’-এর পেঁড়া, আর বিশ্বনাথের গলির বাঁ হাতে নামহীন এক ছোট্ট দোকানের রাবড়ি অমৃততুল্য, দুই বন্ধুই একসঙ্গে বলে উঠি। এমনকি রাতে ঘরে ফেরার পথে বাদাম শরবতে ভাঙ মিশিয়ে নিতে ভুলি না। গেস্ট হাউজের পাশেই ঝুপড়ি দোকানে পসার সাজিয়ে বসে থাকেন কল্যাণ ভাই। এ এক আশ্চর্য দোকান – চব্বিশ ঘণ্টা খোলা; ভোরবেলা মালাই চা দিয়ে শুরু করে রাতে কড়াই থেকে গরম গুলাব জামুন তোলা অব্দি থাকেন প্রৌঢ় কল্যাণ ভাই ও তাঁর স্ত্রী, আর সারারাত দোকানে মিষ্টি আর গরম রুটি সবজি নিয়ে শ্মশানবন্ধুদের সেবায় থাকে তাঁদের জোয়ান ছেলে। শরবতের সঙ্গে সে দোকানের মিঠাই খেয়ে গান ধরে সায়নদীপ। সুখে-দুঃখে-ভাঙে বাঙালি যাঁকে পাশবালিশেরও আগে টেনে নেয়, সেই রবি ঠাকুর এ যাত্রা ছাড় পেলেন, কারণ আমাদের দুজনকেই সে রাতে রামপ্রসাদীতে পেয়েছিল। 

ভোররাতে চটজলদি ঠাণ্ডাজলে স্নান সেরে একবার বিশ্বনাথ দর্শনে যাই দুই বন্ধু – মঙ্গলারতির পর এই সময়টা ঘণ্টাখানেক ফাঁকা থাকে মোটামুটি। শুনশান রাস্তায় পা চালিয়ে শীত কাটাতে কাটাতে এগিয়ে যাই আমরা; ভেজা, শীতল গলি, তস্য গলি দিয়ে ঘুরে ফিরে অবশেষে গর্ভগৃহে পেন্নাম ঠুকি। বেরিয়ে আসি যখন, ভোরের আলো ফুটতে তখনও দেরি। সদ্য খোলা চা-দোকান থেকে দু’ কাপ চা হাতে দশাশ্বমেধে পড়ে থাকা কাঠের পাটাতনে গিয়ে বসি। গঙ্গার গা দিয়ে দূরে, আরও দূরে বেঁকে গেছে ঘাটের সারি, অতন্দ্র প্রহরী হয়ে ওরা দাঁড়িয়ে আছে – বন্ধুত্বের মতোই প্রাচীন। আর ঘণ্টা কয়েকেই তল্পিতল্পা বেঁধে রওনা দিতে হবে মুঘলসরাইয়ের উদ্দেশ্যে, ফেরার ট্রেন। মায়া লাগে ছেড়ে যেতে এই দু’দিনেই – রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ এভাবে বাঁধে এই শহরে। যদি পায়ে হেঁটে এই নব্বইটা ঘাটের সারি একবার ঘুরে নেওয়া যেত ফেরার আগে ... যাবি?

“বেশ তো, চল! পথ চলতে আবার আপত্তি কিসের!”

#সিলি পয়েন্ট # ভ্রমণ # শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী # বারাণসী #Benaras # Suvankar Ghosh Roychowdhury # travelogue # silly point

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

7

Unique Visitors

181994