বিবিধ

পেন, স্ক্যালপেল, Life (প্রথম ভিজিট)

ডাঃ ঋতঙ্কর পাত্র June 4, 2021 at 5:13 am বিবিধ

প্রথম ভিজিট

চারপাশে এখন মৃত্যুমিছিল। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ মারণঢেউ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের মাঝে। এখন যখনই আত্মীয় কেউ ফোন করে মনের মধ্যে প্রথম প্রশ্ন এটাই উঠে আসে যে কোভিড হল নাকি?  বহুদিন পরে কারোর সাথে কথা হলে উঠে আসেই পরিচিত কারো মৃত্যুর কথা। আর হাসপাতালে তো আনাচে কানাচে মৃত্যু..  

যাই হোক, এই কঠিন সময়ে বেঁচে যাওয়ার গল্প বলা যাক। পশ্চিমবঙ্গে তখন ১৫-১৬ হাজার করে কোভিড কেস হচ্ছে প্রতিদিন। সাথে ভোটরঙ্গ চলছে চারিদিকে। এরকম সময় একদিন আউটডোরে দেখাতে এল খুব পাতলা চেহারার এক মহিলা। নাম ধরে নিন আরতি। বয়স বেশি না, ২৫ মতো। বাইরে কোথাও তার পিত্তথলির অপারেশন হয়েছে। ১৩-১৪ দিন আগে। প্রথমে ভালোই ছিল। আস্তে আস্তে জন্ডিস শুরু হয়েছে। পেচ্ছাপ ঘন হলুদ হচ্ছে। চোখের চামড়া ভয়ংকর হলুদ। মহিলার বাড়ি বর্ধমানে। সেখান থেকে এসেছে। স্যারকে দেখানোর পর স্যার বললেন, “ভর্তি কর।” ব্লাড রিপোর্টে বিলিরুবিন তখন ১২ ছুঁইছুঁই। এসব ক্ষেত্রে ধরেই নেওয়া হয় যে পিত্তথলি কাটতে গিয়ে কোনোভাবে পিত্তনালিতে কিছু ক্ষতি হয়ে গেছে। পিত্তথলি অপারেশানের এটা সব থেকে কমন আর সব থেকে সাংঘাতিক জটিলতা যাকে বলে। বাইরে কে অপারেশান করেছে সে প্রশ্নের কোনও ঠিকঠাক উত্তর পাওয়া গেল না। ধরেই নেওয়া হল কোনো কোয়াক অপারেশান করে এই কান্ড ঘটিয়েছে। MRCP বলে একটা পরীক্ষা আছে। তাতে দেখা যায় পিত্তনালির কীরকম ক্ষতি হয়েছে। তাতে ধরা পড়ল ভয়াবহ চিত্র।  লিভার থেকে বেরিয়ে দুটো ছোট পিত্তনালি যেখানে মিশে বড় পিত্তনালি তৈরি হয় সেই সঙ্গমস্থলে সেলাই করে দিয়েছে কেউ। যার ফলে পিত্ত যে স্বাভাবিক রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে রক্তে মেশে সেটা আর হচ্ছে না। তাই শুরু হয়েছে জন্ডিস। 

এবারে এই ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য লাগে গ্যাস্ট্রোসার্জারির লোকজনের। মানে যারা এইসব অপারেশানে সুপার স্পেশালাইজেশনের আরো জটিল ৩ বছরের কোর্স করেছে। স্পেশালাইজড সার্জেন যারা। কিন্তু আমার হাসপাতালে তো সেই বিভাগই নেই। অতঃপর চিন্তিত হয়ে আমাদের স্যার যোগাযোগের চেষ্টা করলেন নিজের এক পুরোনো ছাত্রকে, যে এখন এই নিয়ে স্পেশালাইজেশান করে এখন গ্যাস্ট্রোসার্জেন।

এইসব চলাকালীন আরতির জ্বর এল। কোভিড টেস্টের রিপোর্ট নেগেটিভ। হাইডোজ এন্টিবায়োটিক চালু হল। ভর্তি হওয়ার ১১ তম দিনে দেখা গেল আরতির পেট ফুলে ঢোল। জরুরি ভিত্তিতে পেটের আলট্রাসোনোগ্রাম আর সেখান থেকে ছুঁচ ঢুকিয়ে দেখা গেল পেটময় পিত্ত ছড়িয়ে পড়েছে। হিসেব পুরো গোলমাল হয়ে গেল আমাদের। MRCP বলছে পিত্তনালির রাস্তা বন্ধ, তাহলে এভাবে পিত্ত কিভাবে এল? এদিকে পেটের মধ্যে পিত্ত জমতে থাকলে সেখান থেকে হবে ইনফেকশান, আর সেখান থেকে নিশ্চিত মৃত্যু। তাই এটা কীভাবে হল জানতে হলে একটাই উপায় - এক্সপ্লোরেটারি ল্যাপারোটোমি, বা পেট কেটে ভেতরে ঢুকে কারণ অনুসন্ধান করা।  

অগত্যা সেইদিনকেই পেট কেটে ভেতরে ঢোকা হল। গোটা পেটময় হলুদ পিত্ততে ভরা। যেন পেটের ভেতরে সমস্ত অঙ্গগুলোকে কেউ হলুদ বেটে দিয়ে চলে গেছে। প্রায় ৭ লিটার পিত্ত বেরোলো। আর দেখা গেল পিত্তনালি কেটে দু ফাঁক হয়ে বসে আছে। তাহলে কি MRCP ভুল দেখিয়েছিল? আসলে যেখানে ওই পিত্তনালিকে সুতো দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, সেই জায়গাটা আস্তে আস্তে অক্সিজেন আর রক্তের অভাবে পচে যায়। একে বলে নেক্রোসিস। তার ফলে সেলাই আস্তে আস্তে শুকিয়ে গিয়ে একসময় নিজে থেকেই কেটে যায়। তাই যে পিত্ত এতদিন আসতে পারছিল না বন্ধ রাস্তার জন্য, সেটা তখন উন্মুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পেটের ভেতরে। প্রকৃতি কী সুন্দর অথচ কী ভয়ংকর। তাহলে এবারে রাস্তা কী? আর এর পরের চিকিৎসাই বা কী? 

নিয়ম অনুযায়ী, যেখানে পিত্ত লিক করেছে সেখানে আমরা দুটো ড্রেন বসিয়ে রাখি - যাতে ওই পিত্ত পেটের ভেতরে ছড়িয়ে না পড়ে চলে আসে পেটের বাইরে। তাও সাবধান হওয়ার জন্য পেলভিস, মানে মানুষের শরীরের সব থেকে নীচু অংশ যেটা, সেখানেও তৃতীয় ড্রেনটা দিই যাতে কোনোভাবে পেলভিসে কিছু জমলে সেটাও বেরিয়ে আসে। অপারেশান ঠিকঠাক মিটে গেল। অপারেশানের পর আমি আর আমার কলিগ আনন্দে একটা করে সিগারেট ধরিয়ে চা খেয়ে বেরিয়ে আসি। পেশেন্ট চলে যায় ওয়ার্ডে। কিছুক্ষণ পরে দেখতে যাই। আরতি জানান, ব্যাথা ছাড়া আর কোনও অসুবিধা নেই। 

৭-৮ দিন ভালোয় ভালোয় কেটে যায়। স্যার নিজের ছাত্রের সাথে কথা বলে ফেলেন। তারা বলে দেয় যে, একটু ভালো হলেই পাঠিয়ে দেবেন আমাদের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে করে দেব দরকারি অপারেশন, পোশাকি ভাষায় যার নাম হেপাটিকো-জেজুনোস্টোমি। মানে লিভারের নালির সাথে খাদ্যনালির একটা অংশকে জুড়ে দেওয়া যাতে পিত্ত লিভার থেকে সোজা খাদ্যনালিতে যাবে। যেমন জটিল নাম, তেমনই জটিল অপারেশন। আরতি কিন্তু ভালোই থাকে। তার ড্রেন দিয়ে পিত্ত আসে। স্বাভাবিক অবস্থায় দিনে আমাদের দেহে ৭০০-৮০০ মিলিলিটার পিত্ত বেরোয়। ওর ৩ টে ড্রেন দিয়ে যোগ করে আমাদের ওরকম হিসেব আসে। তার মধ্যে পেলভিসের ড্রেনে সবথেকে কম। মানে ভালো লক্ষণ। আসল জায়গার ড্রেন কাজ করছে। আরতি ৩ টে ড্রেন নিয়ে হাঁটাচলা শুরু করে আস্তে আস্তে। শুধু হাসপাতালের খাওয়া নিয়ে বড় অভিযোগ তার। আর এই ২০ দিনে বড্ড রোগা হয়ে হাড় জিরজিরে হয়ে গেছে। রাউন্ডে এসে তাকে বলা হয়, “রোজ ৪টে করে ডিম খাও। সাথে ভালো করে মাছ মাংস।”  

১৪ নম্বর দিনে আসে বিপদ। ৫০মিলিলিটারের কম পিত্ত আসা পেলভিসের ড্রেনে সেদিন প্রায় ২০০-৩০০ মিলিলিটার। বাকি দুটো ড্রেনে কিছু নেই। আমাদের মাথায় আসে, তাহলে বাকি দুটো বোধহয় ব্লক হয়েছে মুখে কিছু আটকে গিয়ে। এদিকে পেট ফুলছে। স্যার চিন্তিত। বাকি দুটো ড্রেন একটু টেনেটুনে সামান্য সরিয়ে দেখার চেষ্টা করা হল। পরদিন সেই এক গল্প। পেট আবার ফুলে গেছে আগেরবারের মত। আরতি ভয়ে বলে, “গ্যাসে আমার পেট ফুলেছে গো!” আবার সেই আলট্রাসোনোগ্রাম। তাতে দেখা যায় পেট ভর্তি আবার পিত্ত। আর ড্রেন? সেটা সরে গেছে যেখানে রাখা হয়েছিল তার এক মাইল দূরে। আরতিকে চেপে ধরি আমরা, “এই! টানাটানি করেছিলে এটা নিয়ে?”

অনেক জোরাজুরিতে আরতি স্বীকার করে। হ্যাঁ, টানাটানি করেছে দু তিনদিন ধরে। অগত্যা প্রচণ্ড বকাবকি। কারণ আমাদের আবার সেই পুরানো রাস্তায় আবার ল্যাপারোটোমি করতে হবে। আর দুটো ল্যাপারোটমি তাও এরকম অবস্থায়, মানে বাঁচার চান্স কম। বাড়ির লোককে রেগে গিয়ে বলি," তোমরা কী করো যখন এরকম করেছে ও?" উত্তর আসে, "এভাবে তিনখান  নল নিয়ে চললে কী করে বুঝব বাবু কোনটা টানছে বা টানছে না?" 

অগত্যা আরতিকে আবার তোলা হয় অপারেশান টেবিলে। এনাস্থেশিয়ার বন্ধুও ভয় পাওয়ায় যে অজ্ঞান করে ফেরত আনতে পারার সম্ভাবনা কম। তবুও আবার হয় এক্সপ্লোরেটারি ল্যাপারোটোমি। পুরনো জুড়ে যাওয়া ক্ষতস্থানে আবার পড়ে নতুন ইনসিশান। আবার পেট থেকে বেরোয় ৪-৫ লিটার পিত্ত। ড্রেন আবার ঠিকভাবে নতুন জায়গায় বসাই। ভাগ্যক্রমে, আরতি কিন্তু ফিরে আসে। আমরা দু বার মাথা চুলকে ওকে গিয়ে বলি যে এবারে টানাটানি করলে হাত পা বেঁধে দেব। 

তারপর দু বেলা দেখতে যাওয়া। ঠাকুরের নাম জপ করে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াই আমি আর আমার সহকর্মী সত্রাজিত। ঠাকুর! ড্রেন যেন ঠিকঠাক ভাবে কাজ করে! ব্লাড রিপোর্ট যেন নর্মাল আসে! রোজ বলি, “টানাটানি করোনি তো?” উত্তর আসে, "আর কখনো করি?" এভাবে কেটে যায় আরও দিন ১৫।  ভয়ে ভয়ে থাকি যে আগের বার এইসময় হয়েছিল, এবারেও যদি হয়? দ্বিতীয় অপারেশানের ২০ দিন পর আস্তে আস্তে ৩টে ড্রেনে পিত্ত কম আসা শুরু হয়। আরো দু দিন পর দেখা যায়, আসল জায়গার একটা ড্রেনে আগের ৫০০ মিলিলিটার থেকে পিত্তের পরিমাণ নেমে এসেছে দৈনিক ৭৫-১০০ মিলিলিটারে। এদিকে পেশেন্টের পেচ্ছাপ হলুদ হচ্ছে। আবার কু ডাক দেয় আমাদের মন। সকালের রাউন্ড শেষে দৌড়ে যাই স্যারের কাছে। সব ডিটেলসে বলি। 

স্যার শুনে হাসেন। বলেন, “পেশেন্টকে ছুটি করার সময় এসেছে বুঝলি!”

খুব অবাক হই। এটা কী বলছেন স্যার? ড্রেন ব্লক হচ্ছে আবার। জন্ডিস হচ্ছে। আর স্যার ছেড়ে দেবার কথা বলছেন?

"আসলে কী জানিস,” স্যার বুঝিয়ে বললেন, “পিত্তনালির যে অংশটা ভালো ছিল সেটাতেও তো রক্ত কম যাচ্ছে। তাই সেটাও আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়। একে বলে stricture। এখানেও সেই প্রকৃতির খেলা। এইবারে আর পিত্তনালি থেকে পিত্ত বেরোনার কোনো ভয় নেই। আমি এটারই অপেক্ষা করছিলাম। এবারে সময় হয়েছে পুরোনো ছাত্রকে ফোন করার।”

স্যারের ঘর থেকে বেরিয়ে আমি আর সত্রাজিত বলাবলি করি, এটা স্যার তাহলে আগেই বলে দিতে পারতেন। ফালতু ভয় পেতাম না। 

আরও পড়ুন : অতএব ভালোবাসা / ব্রতেশ

রাউন্ডের শেষে পেশেন্ট নিজেই স্যারকে ডাকে। এতদিন পর পেশেন্ট প্রথমবার বলে, “ভালো লাগছে স্যার। একটা নল খালি আমার দেহে…।" স্যার বলেন, "ওইটা থাকবে, বুঝলেন মা। আপনাকে ছুটি দিয়ে দেব এবার।" আরতি খুব খুশি। বাড়িতে ওর বাচ্চাটা নাকি আর থাকতে পারছে না ওকে ছেড়ে।

শেষে স্যার বলে যান, “খুব ভাগ্য ছিল পেশেন্টটার। নইলে দুমাসে ৩ টে অপারেশান!” 

আমি ভাবি, “শুধু ভাগ্য? আর বাঁচার ইচ্ছেটা?” 

রোজ রাউন্ডের সময় আমায় জিজ্ঞাসা করা, "স্যার আমি বাড়ি যেতে পারব তো?" আর আমার মাঝে মাঝে হেসে মাঝে মাঝে বিরক্তিতে "হ্যাঁ পারবে" বলে বেরিয়ে চলে আসা - এগুলো? সবাই ওর শুধু ভাগ্যটাই দেখল। কিন্তু এই অফুরান অদম্য বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা দেখল না। এই ইচ্ছেটাই তো আমাদের বিশেষভাবে দরকার এই কঠিন সময়ে। 

আরও পড়ুন : পরামর্শ / শৌভিক মুখোপাধ্যায়

আরও ৩-৪ দিন পর আরতির ছুটি হয়ে যায়। এখন সে মেডিক্যাল কলেজে অপারেশানের জন্য ভর্তি হয়েছে। গ্যাস্ট্রোসার্জারির স্পেশালাইসড ডাক্তাররা ওর হেপাটকো-জেজুনোস্টোমি করবে। প্রায় ৬-৭ ঘন্টার কঠিন অপারেশান। আমার স্থির বিশ্বাস আরতি ঠিক হয়ে উঠবে। আবার ফিরে যাবে বর্ধমানের গ্রামের বাড়িতে। বাড়ির উঠোনে ঘুঁটে দেবে। ধান ভানবে। মেলায় ছেলেকে নিয়ে যাত্রা দেখতে যাবে। আবার ফিরে  যাবে স্বাভাবিক জীবনে। 

আমাদের কি মনে রাখবে আরতি? না রাখলেই বা কী? আমাদের ওকে কিন্তু মনে থেকে যাবে ঠিক। 


[লেখক নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক] 

..........................

[পোস্টার : অর্পণ দাস]

#Covid #Pandemic # ঋতঙ্কর পাত্র #সিরিজ #series #hospital #হাসপাতাল #সিলি পয়েন্ট #অর্পণ দাস

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

45

Unique Visitors

181952