গল্প

পরিযায়ী

আবু তাহের June 27, 2021 at 12:45 pm গল্প

মাঝে মধ্যেই ভাগীরথী মেসের আশেপাশে লোকজন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এটা মেয়েদের মেস। তাই বুঝি আশেপাশে সবসময় ছেলেরা ঘুরঘুর করে। রেজাউল করিম সরণির গা চিরে একটা রাস্তা এঁকেবেঁকে এ-গলি ও-গলি হয়ে চলে গেছে গঙ্গার ঘাটের দিকে। পাশেই একটা মন্দির রয়েছে। একটা নিমগাছের চারপাশে বাঁধানো চাতাল বাড়িগুলো এত ঘিঞ্জি যেন মনে হয় দেওয়াল ফুঁড়ে এক অন্যের শরীরে সেঁধিয়ে যাবে। সরু রাস্তার ভেতর দিয়ে দু'জন মানুষ পাশাপাশি সাইকেল চালিয়ে গেলে ঠোক্কর লাগে।

জানলা দিয়ে স্নিগ্ধা এসবই লক্ষ্য করে। তাদের মেসটাও ভাগীরথীর পাশে। অবশ্য মেস বলতে একটা দোতলা বাড়ির নীচের তলার তিনটে ঘর। তার এক একটা রুমে তিনজন করে থাকে।

লকডাউনের সময় সবাই বাড়ি চলে গেছে।দীগন্তা আর মৌসুমি রঘুনাথগঞ্জ, কেয়াদি ইসলামপুরে, তিয়াষাদি বেথুয়াডহরি। কেবল নীচের তলায় দু'জন রয়েছে। স্নিগ্ধার কমার্স কলেজ। এখন তো বন্ধই। নাইসি লালদিঘির কাছে একটা মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবে কাজ করে। দুপুরের দিকে কাজে বেরোয়। ফিরতে রাত হয়।

সন্ধ্যাবেলা থেকে ঝড় উঠেছে। আকাশ ছেয়ে ফেলেছে মেঘ জমানো অন্ধকার। কাছাকাছি অনবরত বাজ পড়ছে। শিলাবৃষ্টিতে মন্দিরের কাছে বরফকুচি জমে ডাঁই হয়ে আছে। হঠাৎ করে লোডশেডিং হয়ে গেল। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে দরজার আশেপাশে একবার দেখে নিল স্নিগ্ধা। কেউ নেই। বারান্দায় একটা বেড়াল আর একটা কুকুর থাকে। সেগুলো কোথায় গেল এই ঝড়ঝঞ্ঝার রাতে। একটু চিন্তা হয় । নাইসি ফোন করেছিল। সে আজ আসতে পারবে না। তাদের ল্যাবের নিচ থেকে কোনো টোটো পাচ্ছে না । এই পরিস্থিতিতে কেউ বের হবে বলেও মনে হয় না। অবশ্য নাইসিদের ল্যাবে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে ‌।

স্নিগ্ধার মনে কু ডাকছে। সারারাত এই বাড়িতে সে একা থাকবে কী করে। বাড়ির মালিক কলকাতায় ছেলের কাছে  বেড়াতে গিয়েছিল। হঠাৎ করে লকডাউন ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় আর ফিরতে পারেনি। এই ঝড় বৃষ্টির রাতে তাকে একাই কাটাতে হবে! মন্দিরের পাশে নিমগাছটা মাথাটা ভূতে পাওয়া মানুষের কালো লম্বা চুলের মাথার মত অনবরত দুলে চলেছে এপাশ ওপাশ। স্বপ্নেও কখনো তার জীবনে এমন দুঃস্বপ্নের রাত আসেনি ।

আজ দু বছর হলো সে বাড়ি যায়নি। বাবা-মায়ের সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে ঘর ছেড়েছে অনেকদিন। নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে এই মেস-জীবন কাটাচ্ছে। আজ বাবা-মায়ের কথা কী একটু বেশিই মনে পড়ছে? নাহ্! যে বাবা-মা নিজের একমাত্র মেয়েকে দু'বছর ধরেও দেখতে আসেনি তাদের জন্য মন কেমন করার প্রশ্নই নেই। কেন যে এমন অন্যায় দাবি মনে প্রশ্রয় পেতে‌ চায়। ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে চায় এইসব উটকো চিন্তা।

সেই বিয়েটাও তার টেঁকেনি। বাড়িতে সেটা জানিয়েওছিল। কিন্তু তারাও গোঁ ধরে বসে আছে। মেয়েকে ঘরে তুলতে চায়নি। কেবল করুণার পাত্র হয়ে স্নিগ্ধাও বেঁচে থাকতে চায় না। সে শিরদাঁড়া সোজা রেখে দাঁড়িয়ে বাঁচবে। বাবা-মা যেদিন তার মনের ইচ্ছেকে মূল্য দেবে সেদিনই সে ফিরে যাবে। তার আগে কোনওভাবেই নয়। 

বান্ধবীরা কত বুঝিয়েছে,"তুই একটা ভুল ছেলের পাল্লায় পড়ে নিজের জীবনটা নষ্ট করে ফেলিস না! বাড়ি ফিরে যা। কাকু কাকিমাকে সব জানালে তারা তোকে ঠিক ফিরিয়ে নেবে!"

-"কারও দয়ায় বাঁচতে চাইনা রে,তারা যদি সত্যি আমায় ভালোবাসে তাহলে একবার ফোন করে খোঁজ নিক। একবার আমার মেসে এসে দেখা করে যাক।" দৃপ্ত কণ্ঠে সে জানিয়ে দিয়েছিল।



স্নিগ্ধার মেসে মা-বাবা এসেছে। কতদিন পর!  দরজায় বেল দিতে সে ছুটে গিয়ে দেখে তার ছোটবেলার দুই জগত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। মায়ের কোলে মাথা দিয়ে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বাবা তার মুখ দুখানা তালুর মধ্যে নিয়ে আদর করছে।  মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে, "বুড়ি কিচ্ছু হয় নি আমরা তো আছি নাকি!"

স্নিগ্ধার তবু কান্না থামে না। মা-বাবা কে ছেড়ে  দু'দুটো বছর সে কী করে কাটিয়ে দিল। পিতা-মাতার স্নেহ ভালোবাসা ছাড়াই কীভাবে হেলায় নষ্ট হল এতগুলো ঘন্টা,দিন,মাসের হিসেব। মেসের বন্ধুদের ভালোবাসায় সে বেঁচেছিল। সেসব ভেবেই বুকে চাপ ধরে আসছে। জোরালো কান্নায় ভেঙে পড়ছে বছর বাইশের যুবতী। মায়ের পিঠে মৃদু মৃদু আঘাতে উগরে দিচ্ছে জমে থাকা ক্ষোভ।

-" কেন তোমরা একবার আমার খোঁজ নাওনি? আমি মরে গেছি কি বেঁচে আছি তোমাদের একবারও জানতে ইচ্ছে হয়নি !" তীব্র চিৎকার আর কান্নায় ফেটে পড়ছে স্নিগ্ধা।  চোখের কোল বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। মা বাবার মুখ অপরাধীর মতো থমথমে। লম্বা গ্রীবা কেঁপে কেঁপে উঠছে,কন্ঠনালী ওঠানামা করছে অনবরত। মুখ দিয়ে গোঙানির মত আওয়াজ বের হচ্ছে।

"স্নিগ্ধা! অ্যাই! অ্যাই স্নিগ্ধা! কী হয়েছে? খুব ভয়ের কোনো স্বপ্ন দেখছিস? ওঠ ! ওঠ! আমি এসে পড়েছি।"  নাইসির চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল।

এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো‌। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল  ব্যাগে।

নাইসি জিজ্ঞেস করলো, "এই তুই কোথায় বেরোচ্ছিস সকাল সকাল। অকারণে বাইরে বেরোলে পুলিশ ধরে ঠ্যাঙাবে।"

-"আমি বাড়ি যাব নাইসি।"

হঠাৎ বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে নাইসি চমকে উঠলো। মুখ দিয়ে কথা সরছে না। তবে কি কাল বাড়ি না ফেরার জন্য, তার উপর রাগ করে এই কঠিন প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ ?  না! তা নয়।নাইসির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তা বলছে না। স্নিগ্ধা সত্যি সত্যি মা-বাবার কাছে ফিরে যেতে চাইছে।কারও জন্য নয় নিজের জন্য।

"কিন্তু এইসময় তো কোনো যানবাহন পাবি না। আবার পুলিশও টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে ।কী করে যাবি? লকডাউন টা শেষ হলে গেলে ভালো হতো না!"

-"না, নাইসি আমি আজই মা-বাবার কাছে ফিরে যেতে চাইছি। বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে রে।"

-"আর হ্যাঁ, শুনিসনি, পরিযায়ী শ্রমিকরা দু'শো পাঁচ'শ কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে দিনের পর দিন ফিরে আসছে। কিসের টানে জানি?। মাটির টানে। মায়ের টানে।আমিও এই শহরে বাস করতে করতে কেমন যান্ত্রিক হয়ে পড়েছিলাম।শিকড় উপড়ে পড়ে থাকতে চেয়েছিলাম শহরের ব্যস্ততায়। ডুব দিয়ে দেখলাম জল খুব গভীর রে।ছোঁয়া যায় না। স্পর্শ করা যায় না।বাস করা তো অনেক দূরের কথা। ঠাঁইই পেলাম না।

আরও পড়ুন : কাবিলের লকডাউন জীবন / আবু তাহের

আমাকে কোনও পুলিশ ধরবে না। ফিরে গিয়ে না হয় লকডাউন মানব আবার। তবু এই অপরাধটুকু আমাকে করতেই হবে। ক'মাইল রাস্তা নাহয় হেঁটেই যাব। পরিযায়ীদের রাস্তা কেউ আটকানোর কথা নয়।

..................

[অলংকরণ : অভীক] 

#সিলি পয়েন্ট #web portal #ওয়েবজিন #গল্প #রবিবারের গল্প #story #আবু তাহের

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

56

Unique Visitors

181977