গল্প

দায়

শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী June 6, 2021 at 5:11 am গল্প

..........

ডাক্তার, নার্স, নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ যখন একেবারেই হাত তুলে দিল, বাধ্য হয়েই সাগ্নিককে যোগাযোগ করতে হল অচেনা কিছু ফোন নম্বরে, অক্সিজেনের জন্য। দরজার মাঝে যে ছোট্ট চৌকো কাচের জানলা করা, সে দিয়ে দেখা যাচ্ছে, ওপারে বেডে হেলান দিয়ে আছেন বাবা, নাকে নল। তাঁর অবস্থা খাবি খাওয়া মাছের মতো। সিলিন্ডারে শেষ হয়ে আসছে অক্সিজেন; একটু আগেই এসেছে ফুসফুসের সিটি স্ক্যান রিপোর্ট – সব আবছা, ঝাপসা। 

#URGENT #OXYGEN_CYLINDER_NEEDED

PATIENT NAME: SAROJ SEN

AGE: 76 YRS

ADMITTED AT: CARE-CURE NURSING HOME, BELEGHATA

CONDITION CRITICAL. SPO2: <73.

PLEASE PROVIDE VERIFIED LEADS.

তিনবারের চেষ্টায় এই বয়ানটা লিখে ফেসবুকে পোস্ট করল সাগ্নিক। নিজের দেওয়ালে, দুটো কোভিড-সম্বন্ধীয় গ্রুপে; নিজের পোস্টে দু মিনিট পর ফিরে এসে দেখল, দুজন আরও তিন-চারজনকে মেনশন করেছে।  স‍্যাড রিঅ্যাক্ট করেছে সাত জন। সাগ্নিক ট্যাগ করল সতেরো জন মানুষকে। বেরিয়ে এল। হোয়াটসঅ্যাপে স্ট্যাটাস আপডেট দিল এই একই বয়ান। ফোন লক করে  লোহার চেয়ারে ছুড়ে ফেলল। যেতে যেতে একজন হাউজ-কিপিং স্টাফ ফিরে তাকালেন। আবার চলে গেলেন। স্বাভাবিক। এটাই স্বাভাবিক, তাঁর এবং সাগ্নিকের মনে হল। উঁকি মেরে আরেকবার বাবাকে দেখল সাগ্নিক। মানুষটার বুক হাপরের মতো ফুলছে আর চুপসে যাচ্ছে, চোখ আধবোজা, ঘোলা। নাক দিয়ে যেটুকু অক্সিজেন ঢুকছে, তার বাইরে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন মুখ দিয়ে টানতে বাতাস। কিন্তু জোর ফুরিয়ে আসছে। 

প্রচণ্ড কঠিন সময়েও ফোন করতে অস্বস্তি হয় সাগ্নিকের। তাই, ও একেবারেই চায়নি ফেসবুকে পাওয়া অচেনা লিডে ফোন করে করে ওকে খবর করতে হোক অক্সিজেন সিলিন্ডারের। তবে এখন অনেক কিছুই চাওয়া না চাওয়ার অতীতে। ওদিকের করিডর থেকে কান্না শোনা যাচ্ছে; সাগ্নিকের পা অল্প অল্প কাঁপছে বলে লোহার চেয়ারে বসে পড়ল ও। হাতের পাতাগুলো বিচ্ছিরিরকম ঘেমে, ভিজে ঠান্ডা হয়ে এসেছে। ফোনটা আনলক করার সময় প্যাটার্নটা দিতে গিয়ে দুবার হাত পিছলে গেল। তিনবারের বার আনলক করে ফোনটা হাতে নিয়েই চোখ বন্ধ করে একটু স্থির হওয়ার চেষ্টা করল সাগ্নিক। সম্ভবত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ও একটা মৃত্যু দেখতে চলেছে। জীবনের প্রথম বড় মৃত্যু। এদিকে ওদিকে পিতৃবিয়োগ কথাটা দেখে-শুনে এসেছে এতদিন। এবার হয়তো – আচ্ছা এখনই ও ফেসবুক খুলে কী দেখতে পারে! খেলছে সাগ্নিক নিজের সঙ্গে – “চিন্তা করিস না?” “সে কী! কবে হল?” “এই সবকটা নাম্বারে ট্রাই করে দ্যাখ ভাই?” ফেসবুক খোলে সাগ্নিক। ২৪টা স‍্যাড রিঅ্যাক্ট, ৫টা লাইক, ২টো ‘লাভ’! কমেন্টে ৫টা নাম্বার এসেছে। কত সংখ্যা! ১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭ ৮ ৯ ০ কতরকম অর্ডারে সাজানো। এবার ফোন করতে হবে। 

-হ্যালো।

-হ্যালো আচ্ছা আমি বেলেঘাটা থেকে ...

-অক্সিজেন এখন নেই দাদা।

দুই আর তিন নং ফোনগুলো বেজে গেল।

-বলুন।

-অক্সিজেন সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে?

-কোত্থেকে বলছেন?

-বেলেঘাটা কেয়ার-কিওর...

-না দাদা, আমরা সোনারপুরে। সম্ভব নয়। আপনার পরিচিত কেউ আছে এদিকে? নিয়ে যেতে পারবে? 

-দেখছি।

-দেখুন, বেশিক্ষণ ধরে রাখা যাবে না।


-হ্যালো।

-আচ্ছা এটা কোথাকার নাম্বার।

-জি?

-এটা কোথাকার ... উফ, কিধর সে বোল রহে হ্যাঁয় আপ?

-কানপুর সে জি!

সোনারপুরের আশেপাশে ... নাহ, কাউকেই মনে পড়ছে না! হোয়াটসঅ্যাপ নীরব। এখনও। সতেরো জন দেখেছে ওর স্ট্যাটাস, তার মধ্যে চারজন নিজের স্ট্যাটাসে দিয়েছে স্ক্রিনশট নিয়ে। উত্তর নেই। মঞ্জিমাকে একবার যোগাযোগ করা যায়? ও তো শেষ কিছুদিন এই ধরনের সাহায্যের কাজে বেশ যুক্ত আছে, দেখছিল। নম্বর ... নম্বর ... কাঁপা কাঁপা হাতে কন্ট‍্যাক্ট লিস্ট হাতড়াতে শুরু করে সাগ্নিক। 

-সাগ্নিক, বল।

-মঞ্জিমা, একটা সাহায্য লাগবে রে। বাবার অবস্থা ক্রিটিকাল। অক্সিজেন সিলিন্ডার চাই। একটু দেখতে পারবি, যদি ...?

-এখনই ডিটেলস পাঠা আমায়। খুঁজছি।

-আচ্ছা, এই পাঠাচ্ছি। 

আরও পড়ুন : বিন্যা / শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী

ফেসবুকে গিয়ে ডিটেলস কপি করে মেয়েটিকে পাঠাল সাগ্নিক। মেয়েটি সেই ডিটেলস পাঠিয়েছিল আরও প্রায় কুড়িজনকে, তার মধ্যে আমি একজন। সময়টা তখন যত দূর মনে পড়ে, দুপুর তিনটে। খেয়ে শুয়েছিলাম এলিয়ে; লকডাউন শুরু হওয়ার পর ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম, কাজের চাপ যথেষ্ট কম। দুপুরে একটু গড়িয়ে নেওয়াই যায়। শুনেছি ‘নোম্যাডল্যান্ড’ এসেছে হটস্টারে, বিকেলে বাদবাকি কাজ গুটিয়ে ওটা দেখব। মোবাইলের আলো জ্বলল। তাকালাম। মঞ্জিমা। প্রতি আধঘণ্টায় হোয়াটসঅ্যাপে স্ট্যাটাস খুললে শুধু এই সাহায্য-তাই সাহায্য চেয়ে ভরিয়ে রাখে। মোস্টলি আনভেরিফায়েড সোর্স, লিড। লোকের সমস্যা বাড়াচ্ছে এসব শেয়ার করে। এখন আবার স্ট্যাটাস ছেড়ে পার্সোনাল চ্যাটে এসে ঢুকেছে। আবার একগাদা নাম্বার, দিচ্ছে বা চাইছে। পরে দেখব।

আরও পড়ুন : সুকুমারের শখ / সায়নদীপ গুপ্ত

এর অনেক, অনেকদিন পর একবার আমার দেখা হয়েছিল মঞ্জিমার সঙ্গে। তখন অসুখ চলে গেছে, সুখও অবশ্য পুরোপুরি ফিরে আসেনি। বহুদিন আগের সেই বিকেলের কথা তুলেছিল কথায় কথায় মঞ্জিমা– সরোজ সেনের অক্সিজেনের ব্যবস্থা হয়নি, সন্ধেতেই সেইদিন দেশের তিন হাজার এগারোজন রোগীর সঙ্গে তিনিও সরকারি মৃতের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন। এখন সেই দুঃসময় আর নেই, তবে সাগ্নিকের অবসাদ কাটেনি পুরোপুরি। মাকে বেচারা হারিয়েছিল ফার্স্ট ওয়েভে, আর সেকেন্ড ওয়েভে বাবা। মঞ্জিমা কেন আমায় এত কথা বলেছিল কে জানে, শুনে মন খারাপ হয়েছিল আমার। মানুষের কষ্টে সেদিন বারিস্তার কফি কাপে তলানি ফেলে এসেছিলাম, ভেবেছিলাম, সাগ্নিকের মতো এমন একজনের গল্প লিখব কোনও ছোটো পত্রিকায়। অতিমারির প্রতি কিছু দায় আমারও থেকে যায় লেখক হিসেবে।  

.........................

ছবি : vector stock 


#সিলি পয়েন্ট #Web Portal #গল্প #story #রবিবারের গল্প #কোভিড #অক্সিজেন #Covid #Oxygen #শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী #Silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

88

Unique Visitors

181887