বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

জৈব-সন্ত্রাস: ভূত ও ভবিষ্যৎ

রাহুল দত্ত Sep 8, 2020 at 9:21 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

(প্রথম কিস্তি)



“পাতালঘর” ছবির সেই গানটা মনে আছে? "অস্তর অস্তর অস্তর... পৃথিবীটা চালাবার একটাই মন্তর৷" আগ্নেয়াস্ত্র বা পারমাণবিক অস্ত্র নয়, বরং আধুনিক সভ্যতার অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র কিন্তু এখন জৈব-অস্ত্রই৷ কারণ, প্রথমত, এই অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক, বৈদ্যুতিন বা প্রযুক্তিগত কোনওরকম জটিলতা নেই৷ কাজেই, মেটাল ডিটেক্টর জাতীয় যন্ত্রের কৌতূহলী চোখ অনায়াসেই এড়িয়ে যেতে পারে৷ দ্বিতীয়ত, এক্ষেত্রে রণকৌশলকারী মেঘনাদের মতই সম্পূর্ণ অগোচরে থেকে অস্ত্রের প্রয়োগ করতে পারেন৷ তথ্যপ্রমাণ সরিয়ে ফেলাও অনেক সহজ৷ তৃতীয়ত, প্রয়োগকারীকে এক্ষেত্রে শুধু প্রাথমিক ইনোকিউলেশান-এর (জীবাণুর প্রবেশ ঘটনো) সময় উপস্থিত থাকলেই চলে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দ্রুত মানুষ থেকে মানুষে, দেশ থেকে দেশান্তরেও ছড়িয়ে পড়ে তার প্রভাব৷ সচেতন হবার আগেই হাতের বাইরে চলে যায় পরিস্থিতি৷

আধুনিক মারণাস্ত্র বলা হলেও রণকৌশলটা কিন্তু অনেকদিনেরই, ইতিহাস সাক্ষী আছে তার৷ আজ থেকে প্রায় ২৪০০ বছর আগে থেকেই মৃতদেহ, পশুর চামড়া এবং বিষাক্ত ছত্রাক ব্যবহার করে গ্রীক ও অসিরীয়দের শত্রুপক্ষের নলকূপ দূষিত করার কৌশলের কথা জানা যায়৷ কিংবা ধরা যাক, চতুর্দশ শতাব্দীতে তাতার’দের কাফ্ফা শহর আক্রমণের কথা৷ কাফ্ফা ছিল ইতালির জেনোয়া-নিয়ণ্ত্রিত একটি সমুদ্রবন্দর৷ দুর্ভাগ্যবশত, এই শহর দখল করার সময়ই তাতার’দের মধ্যে প্লেগ মহামারীর আকার নেয়৷ তারা তখন তাদের মৃতদেহগুলি শহরের মধ্যে নিক্ষেপ করতে থাকে৷ ফলত, তাদের প্রতিহত করতে অগ্রসরমান জেনোয়ার সৈন্যদল তো পিছু হঠতে বাধ্য হয়ই, উপরন্তু সেই প্লেগ বা “ব্ল্যাক ডেথ্” দ্রুত মহামারী এবং ক্রমে অতিমারীর রূপ নিয়ে সারা ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে৷


Black death in Europe
source:https://geneticliteracyproject.org

শুধু ইউরোপেই মৃত্যু হয় ২৫ লক্ষেরও বেশী মানুষের৷ ১৭৬৩ সালে ব্রিটিশ কমান্ডার-ইন-চিফ, স্যার জেফ্রি আর্নস্ট-এর একটি বিবৃতি থেকে, উত্তর আমেরিকায় আদিবাসী রেড-ইন্ডিয়ানদের সাথে চলা যুদ্ধের সময় ওহিও নদীর উপত্যকায় বসবাসকারী উপজাতিদের মধ্যে ব্রিটিশদের উদ্যোগে “স্মল-পক্স” বা জলবসন্তের জীবাণুবাহী কম্বল বিতরণের কথা জানা যায়৷ আজও মনে করা হয়, বিশ্বব্যপী ভয়াল আকার ধারণ করা “স্মল-পক্স”-এর উৎসস্থল কিন্তু ওই উপত্যকাই৷


এবার একেবারে একবিংশ শতকের একটি ঘটনায় আসা যাক৷ সময়টা অক্টোবর, ২০০১, স্থানঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ সাত-সাতটি চিঠি গিয়ে পৌঁছায় টম ড্যাশলে-সহ কয়েকজন সেনেটর এবং বিশিষ্ট সাংবাদিকদের অফিসে৷ উল্লেখযোগ্যভাবে, এগুলি সাধারন চিঠি ছিল না৷ এক্ষেত্রে, এনভেলপের মধ্যে পরিকল্পিত ভাবে ভরা ছিল গ্র্যাণুলার অ্যানথ্রাক্স-পাউডার, যার সংস্পর্শে এলেই হতে পারে কিউটেনিয়াস (চর্মের মাধ্যমে) বা ইনহেলেশান অ্যানথ্রাক্স (শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে)৷ হয়েছিলও তাই, পোস্টাল সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত এবং সেনেটরদের অফিসকর্মী যাঁরাই এর সংস্পর্শে এসেছিলেন তাঁদের অনেকেরই সংক্রমণ ধরা পড়ে৷


Source: FBI/AP

এর তদন্ত করতে গিয়েই কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে পড়ে প্রকাণ্ড কেউটে৷ জানা যায় Ames strain অর্থাৎ অ্যানথ্রাক্স রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু Bacillus anthracis এর ৮৯টি স্ট্রেন(প্রকার)-এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ স্ট্রেন’টির কথা৷ টেক্সাসের Veterinary Medical Diagnostic Laboratory থেকে ফোর্ট ডেট্রিকে, the United States Army Medical Research Institute of Infectious Diseases (USAMRIID)-এর ল্যাবে স্যাম্পেল পাঠানোর সময় এর ভুল লেবেল হয়ে যাওয়ার কথাও জানা যায়৷ এখান থেকেই Ames strain পাঠানো হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬টি ল্যাবে এবং সেইসঙ্গে কানাডা, সুইডেন ও ব্রিটেনের তিনটি ল্যাবে৷


USAMRIID অর্থাৎ ফোর্ট ডেট্রিক ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে আমেরিকার জৈব-অস্ত্র গবেষণার প্রাণকেন্দ্র৷ দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এখানকার “Building 470” বা “অ্যানথ্রাক্স টাওয়ার”-এ প্রায় ৫০০০ অ্যানথ্রাক্স বোমা তৈরীর কথা জানা যায়৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯২৫ সালের জেনেভা প্রোটোকলে জৈব-অস্ত্র “প্রয়োগ”-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও, এর মজুত করা এবং গবেষণা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে কোনও কথা বলা হয়নি৷ এগুলির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয় ১৯৭২ সালের Biological Weapons Convention (BWC)-এ, অর্থাৎ তাৎপর্যপূর্ণভাবে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন কর্তৃক ফোর্ট ডেট্রিকে জৈব-অস্ত্রের গবেষণায় ইতি টানার নির্দেশের ঠিক পরেই৷ ফোর্ট ডেট্রিকে জৈব-অস্ত্র প্রয়োগের পরীক্ষা করা হয় একটি দশ লক্ষ লিটার আয়তনের, প্রকাণ্ড, ধাতব এরোসলাইজেশান চেম্বারের মধ্যে, যা পরিচিত ছিল “Eight ball” নামে৷ এর ভিতরে “ভলেন্টিয়ার”-দের ওপর প্রয়োগ করা হত দুটি ভয়ঙ্কর ব্যাক্টিরিয়া-সংবলিত এরোসল (বাতাসে ভাসমান অতিক্ষুদ্র ড্রপলেট)৷ যাদের একটি ছিল Tularemia রোগসৃষ্টিকারী ব্যাক্টিরিয়া Francisella tularensis এবং অন্যটি ছিল Q-fever সৃষ্টিকারী ব্যাক্টিরিয়া Coxiella burnetii ৷ কি? “V for Vendetta” ছবির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তো?


শুধু আমেরিকাই নয়, বিশ্বযুদ্ধের আবহে জৈব-অস্ত্র প্রয়োগের ক্ষেত্রে অন্যদেশগুলিও কিন্তু পিছিয়ে ছিলনা৷ প্রথম-বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যানথ্রাক্স ও গ্ল্যান্ডার রোগ ছড়াতে গবাদি পশুদের Bacillus anthracis এবং Pseudomonas pseudomallei দিয়ে সংক্রামিত করে জার্মানীর আমেরিকা, রাশিয়া প্রভৃতি দেশে পাঠানোর কথা জানা যায়৷ এদিকে জাপান ১৯৩২ থেকে ১৯৪৫ সাল অবধি জৈব-অস্ত্রের গবেষণা ও প্রয়োগ চালাতে থাকে৷ জাপানী সেনারা চীনের মাঞ্চুরিয়ায় “Unit 731”-এ বন্দীদের ওপর Vibrio cholerae, Shigella spp, Yersinia pestis, Bacillus anthracis, Neisseria meningitides ইত্যাদি অণুজীব এবং ছত্রাকঘটিত ভয়ঙ্কর বিষ টেরোডোটক্সিন প্রয়োগ করার ফলে প্রচুর বন্দীদের মৃত্যু হয়৷ কিন্তু জৈব-অস্ত্রের প্রয়োগের জন্য যে সাবধানতা, পরিকাঠামো এবং প্রশিক্ষনের প্রয়োজন হয় তার কোনওটাই জাপানী সেনাদের ছিল না৷ ফলত, ১৯৪১ সালে নিজেদেরই প্রয়োগ করা জৈব-অস্ত্রের প্রয়োগে প্রায় ১৭০০ জাপানী সৈন্যের মৃত্যু হয়৷ এই ঘটনার প্রভাবে পরের বছর থেকেই ধীরে ধীরে জাপান জৈব-অস্ত্রের সরাসরি প্রয়োগ বন্ধ করতে থাকে৷ ব্রিটিশরাও পিছিয়ে ছিলনা৷ ভারতে পীতজ্বরের প্রাদুর্ভাবের পিছনে এবং ১৯৫৭ তে ওমানে জৈব-অস্ত্রের প্রয়োগের জন্য অনেক সূত্র থেকে ব্রিটিশদের দায়ী করা হয়৷ স্কটিশ উপকূলের গ্রুইনার্ড দ্বীপেও অ্যানথ্রাক্স বোমা নিয়ে পরীক্ষা চালানোর অভিযোগ আসে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে৷


Source:https://nowyouknow.unreel.me

এছাড়া ১৯৬১ তে হংকং-এ এবং ১৯৬৪ তে কলম্বিয়া ও বলিভিয়ার কৃষকদের ওপর আমেরিকার জৈব-অস্ত্র প্রয়োগের খবর প্রকাশ্যে আসে৷ এমনকি, ১৯৬৬ সালে ইরাকে কলেরার প্রাদুর্ভাবের পিছনেও ঔপনিবেশিক শক্তিকেই দায়ী করা হয়৷


নিয়ম যেন তৈরী হয় ভাঙার জন্যই৷ ১৯৭২ সালে Biological Weapons Convention (BWC)-তে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে জৈব-অস্ত্রের মজুত করা এবং গবেষণার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপিত হওয়া সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়নের মত কিছু দেশ গোপনে, “আত্মরক্ষার্থে” জৈব-অস্ত্রের গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকে৷ ১৯৭৮ সালে গ্রেগরি মার্কভ নামে একজন বুলগেরিয়ান লেখক দেশ ছাড়ার পর লন্ডনে কুখ্যাত “Umbrella killing”-এর শিকার হন৷ লন্ডনের একটি বাসস্টপে অপেক্ষারত অবস্থায় থাকাকালীন একজন তার ছাতাটি খুললে মার্কভ অনুভব করেন তাঁর পায়ে যেন সূঁচের মত কিছু একটা এসে ফোটে৷ পরদিন থেকে তিনি অসুস্থতা অনুভব করতে থাকেন এবং ঠিক তিনদিন পর তাঁর মৃত্যু হয়৷ বুলগেরিয়ান সাংবাদিক ভ্লাদিমির কস্টভ-ও প্যারিসে একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন৷ তাঁর শরীর থেকে যে ধাতব শলাকা-টি উদ্ধার করা হয়, ফরেন্সিক পরীক্ষায় জানা যায় তার মধ্যে ছিল রাইবোজোম-নিষ্ক্রিয়কারী মারাত্মক বিষ “রাইসিন”, যা পাওয়া যায় রেড়ি-র বীজ থেকে৷ এই দুটি ঘটনারই নেপথ্যে ছিল তৎকালীন বুলগেরিয়ান কমিউনিস্ট-দের গুপ্ত-সংস্থা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ ১৯৮০ সালে একটি জার্মান পত্রিকা, ঠিক তার আগের বছরই সোভিয়েত ইউনিয়নের স্ভার্দলভস্ক-এ অ্যানথ্রাক্স-এর ছড়িয়ে পড়ার পিছনে সেখানকারই সোভিয়েত পরীক্ষাগারে ঘটা একটি দুর্ঘটনাকেই দায়ী করে৷ পরবর্তী তদন্তে তা প্রমাণিত হয় এবং সংক্রমিত পশুর মাংস খাওয়ার মাধ্যমে সেই জীবাণুর গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার কথাও জানা যায়৷ KGB-এর (সোভিয়েত গুপ্তচর-সংস্থা) কয়েকজন প্রতিনিধি এবং তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েল্টসিনও স্বীকার করেন সেইকথা৷


Source:www.researchgate.net


এছাড়া, উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইরাক যখন কুয়েত দখল করে তখন আমেরিকার পক্ষ থেকে ইরাকের বিরুদ্ধে জৈব-অস্ত্র প্রয়োগের অভিযোগ আনা হয়৷ বিপদটা আরো প্রবল হয় যখন নিজেদের উদ্দেশ্যপূরণের জন্য কিছু গোষ্ঠী, এমনকি ব্যক্তি-বিশেষও জৈব-অস্ত্রের প্রয়োগ শুরু করে৷ ১৯৮৪ সালে আমেরিকার ওরেগন প্রদেশের একটি ছোট শহরে নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং তার ফলাফলকে প্রভাবিত করার জন্য রেস্তোরাঁর স্যালাড-কাউন্টারে Salmonella typhi-র ব্যাক্টিরিয়াল-কালচার স্প্রে করার ভয়ঙ্কর অভিযোগ ওঠে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আধ্যাত্মিক-গুরু “ভগবান শ্রী রজনীশ”(যাঁকে আমরা Osho নামে চিনি) এবং তাঁর অনুগামীদের বিরুদ্ধে৷ যার জেরে অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রায় ৭৫১ জন৷ খোদ বাংলায়, পাকুড় হত্যা মামলায় উঠে আসে হত্যার উপকরণ হিসেবে প্লেগের জীবাণু ব্যবহারের কথা৷ আগামী পর্বে আসছি সেই ঘটনা নিয়ে৷ তবে বলাই বাহুল্য যে, এই ঘটনাগুলি বারবার জৈব-সন্ত্রাসের দিকেই আঙুল তোলে এবং একই সঙ্গে Biological Weapons Convention (BWC)-এর বিফলতাকেও তুলে ধরে৷


ঋণস্বীকার:
১) “A short history of bioterrorism.” By Lyn Gilbert.
২) “Biological Weapons, Bioterrorism, and Vaccines.”- The History of Vaccines-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ৷
৩) “History of biological warfare and bioterrorism.”- by V.Barrasa and G.Greub. “Clinical Microbiology and Infection” জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র৷
৪) “Biological warfare and bioterrorism: a historical review”- by Stefan Riedel.
৫) উইকিপিডিয়া৷
৬) ইউটিউব থেকে সংগৃহীত কিছু ডকুমেন্টারি ভিডিও৷


কভার পোস্টার:https://geneticliteracyproject.org সাইটটি থেকে নেওয়া হয়েছে।


#Biological Weapon #Umbrella killing #Bioterrorism #Vaccines #Clinical Microbiology #Infection #Biological warfare #Science #History #Q-fever #V for Vendetta #Tularemia #Eight ball #Building 470 #United States Army Medical Research Institute of Infectious Diseases #USAMRIID #Ames strain #জৈব-সন্ত্রাস #বিজ্ঞান #রাহুল দত্ত #Black death

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

0

Unique Visitors

181765