ব্যক্তিত্ব

ইলা ঘোষ মজুমদার : প্রথম বাঙালি মহিলা-ইঞ্জিনিয়ার

মন্দিরা চৌধুরী June 18, 2022 at 6:50 am ব্যক্তিত্ব

আগে গেলে বাঘে খাক বা না খাক, যাওয়ার পথটা কুসুমাস্তীর্ণ হয় না। কোনও ক্ষেত্রে প্রথম পা রাখা মানুষের নাম উজ্জ্বল হয় ঠিকই, কিন্তু তা অনেক বাধা-বিপত্তি পেরোনোর পর। তেমনই মানুষ ছিলেন ইলা ঘোষ মজুমদার। নামটা হয়তো আমাদের স্মৃতিতে তেমন উজ্জ্বল নয়, কিন্তু তাতে তাঁর কৃতিত্বের ঔজ্জ্বল্য বিন্দুমাত্র ফিকে হয়না। প্রথম বাঙালি মহিলা ইঞ্জিনিয়ার তথা প্রথম ভারতীয় মহিলা মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার ইলা ঘোষ মজুমদার।

ইলার জন্ম পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরে ১৯৩০ সালে। তাঁর  বাবা যতীন্দ্র কুমার মজুমদার ছিলেন পেশায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মুক্তমনা এই মানুষটির তত্ত্বাবধানেই ইলার পড়াশোনা শুরু হয়। তিনি বারো বছর বয়সেই সাইকেল চালাতেন এবং ষোলো বছর বয়সে মোটর চালাতে পারতেন। নবম শ্রেণি পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে খুলনায় পড়াশোনার পর সাম্প্রদায়িক সমস্যার জেরে ইলারা সপরিবারে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। এরপর বিবিধ সমস্যায় এক বছর লেখাপড়া বন্ধ থাকে তাঁর, একবছর পর তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করেন।

সেই সময়ে খুব কম মেয়েরাই পেশাগত জীবনে প্রবেশ করতে পারতেন। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশের স্থান হত অন্দরমহলে, আর নিজের সমস্ত প্রতিভা পেষাই হত সংসারের জাঁতাকলে। কিন্তু ইলার বেড়ে ওঠা ছিল সমসাময়িক মেয়েদের থেকে খানিক অন্যরকম, তুলনামূলক মুক্ত পরিবেশে। ১৯৪৭ সালে, ভারতের স্বাধীনতার পর ভারত সরকার ঘোষণা করলেন যে , শিক্ষার সমস্ত ক্ষেত্র মেয়ে এবং ছেলে উভয়ের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।  ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে সুযোগ পেলেও ইলা  ডাক্তারি পড়তে চাইলেন না। চাইলেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে, যেটা এতদিন শুধুমাত্র পুরুষরাই পড়তো। ইতিমধ্যেই তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নিকুঞ্জ বেহারি মাইতি শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের দরজা মহিলাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। সে সময় শিবপুরের কয়েকশো ভারতীয় এবং ইউরোপীয়ান ছাত্রের মধ্যে ইলা ছিলেন একমাত্র ছাত্রী। ইলা চেয়েছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে, কিন্তু এই শাখায় অত্যন্ত ভারী যন্ত্রাংশ নিয়ে কাজ হওয়ায় অধ্যক্ষ তাঁকে অনুমতি দেননি, সেই জন্য ইলা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন।

ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াকালীন ক্যাম্পাসে, ইলা চারশোর বেশি ছেলেদের মধ্যে একা ছাত্রী ছিলেন। চেনা পরিবেশ থেকে দূরে এই পরিস্থিতি অস্বস্তিকর হলেও তাঁকে এইসব সমস্যার মোকাবিলা নিজেকেই করতে হয়েছিল। সে সময়ে আর কোনও ছাত্রী না থাকায় ছাত্রী আবাস ছিল না, সেইজন্য ইলাকে থাকতে হত কলেজের লাইব্রেরি সংলগ্ন একটি ঘরে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক পুলিন বিহারি ঘোষ বিশেষভাবে সাহায্য  করেছিলেন ইলাকে, তিনি প্রায় ইলার স্থানীয় অভিভাবকের মতো ছিলেন। এমনকি তিনি ইলার পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করতেও চেয়েছিলেন।

১৯৫১ সালে ইলা স্নাতক হন, ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম স্থায়ী করেন। সমকালীন শিক্ষাব্যবস্থা অনুযায়ী, স্নাতক হওয়ার পর সেই ছাত্রকে শিক্ষানবিশ হিসাবে কিছু সময় কাজ করতে হত। কিন্তু বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যক্ষ মনে করেন, ভারতের কোনও সংস্থা তখনও শিক্ষানবিশ হিসাবে মেয়েদের নেওয়ার জন্য তৈরি ছিলনা। সেইজন্য ইলাকে ইউরোপের স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে যেতে হয় শিক্ষানবিশির জন্য। সেখানে 'বার অ্যান্ড স্টাইড' সংস্থা থেকে তিনি স্নাতকোত্তর স্তরের প্রশিক্ষণ নেন। এরপর দেশে ফিরে এসে ইলা দেরাদুনের 'অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি' নামক একটি ভারী যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানায় যোগ দেন। স্বভাবতই তিনি ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং উৎপাদন বিভাগে কর্মরতা প্রথম ভারতীয় মহিলা। এখানে ইলা ছয় মাস চাকরি করেন। এরপর তিনি ১৯৫৫ সালে দিল্লি পলিটেকনিক কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। কিছুদিন পর বিয়ের পর তিনি পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে আসেন এবং ইন্সটিটিউট অফ জুট টেকনোলজি-তে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। 

ইলা মজুমদারের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব বাংলার প্রথম মহিলা পলিটেকনিক কলেজ স্থাপন করা। ১৯৬৩ সালে কলকাতার গড়িয়াহাট রোডে এই কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়। ইলা মজুমদার ছিলেন এই কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ। তাঁর কর্মকাণ্ড দেখে রাষ্ট্রপুঞ্জের পক্ষ থেকে ইলাকে বাংলাদেশের ঢাকায় একটি পলিটেকনিক কলেজ স্থাপন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশে যান এবং সফলভাবে পলিটেকনিক কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। 

আরও পড়ুন : পনেরো বছর বয়সে প্রথম কাব্যগ্রন্থ : বঙ্কিমকেও মুগ্ধ করেছিল গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর কলম / মন্দিরা চৌধুরী

ইলা মজুমদার, প্রথম প্রথা ভেঙে সাহসের সঙ্গে পা রেখেছিলেন তথাকথিত মহিলা বর্জিত এক ক্ষেত্রে। পরবর্তীতে পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করেছেন। তৎপর হয়ে মহিলাদের প্রযুক্তি শিক্ষায় এগিয়ে দিতে সফল হয়েছেন এবং নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।

......................... 

#Ila Ghose #Engineer #ইলা ঘোষ #ফিচার #silly পয়েন্ট #Bengali Portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

30

Unique Visitors

181928