ফিচার

আইনস্টাইনের ভেংচির রহস্য-সন্ধানে

অর্পণ পাল May 31, 2022 at 11:04 am ফিচার

আলবার্ট আইনস্টাইনের নাম শোনেননি বা তাঁর কোনো ছবিই দেখেননি, এমন শিক্ষিত মানুষ পৃথিবীতে মনে হয় না কেউ আছেন বলে। আর তাঁর ছবিগুলির মধ্যে সবচেয়ে পরিচিতি ছবি হিসেবে যেটি গণ্য হওয়ার মুখ্য দাবীদার, সেটি এই লম্বা জিভ বের করা ছবিটিই। সকলেই দেখেছেন এই ছবি। টি-শার্টে বা পোস্টারে এ যাবৎকাল অব্দি সবচেয়ে বেশি ছাপা হয়েছে এই ছবিটিই। অত বড় মাপের একজন বিজ্ঞানীর এ হেন মুখব্যাদান-ভঙ্গিমার ছবি সত্যিই বেশ মজাদার, আর অভিনবও বটে। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা ছবিটিকে আখ্যা দিয়েছিল ‘Arguably one of the best known press photographs of any 20th century personality’।

এই ছবিটির পিছনে যে ইতিহাস, সেটা বেশ মজার। সেই ইতিহাসই বলব এবার। 

সাল ১৯৫১। তারিখ ১৪ই মার্চ। হ্যাঁ এটা একটা বিশেষ তারিখ, কারণ এইটাই আইনস্টাইনের জন্মদিন। সেদিনটা ছিল তাঁর একাত্তরটি বসন্ত পূর্ণ হওয়ার দিন। আর ততদিনে আইনস্টাইন বিশ্বজোড়া এক নাম। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, সাংবাদিকদের কাছেও তাঁর জন্মদিন যে স্টোরি বা ছবি তোলার জন্য একটা বিরাট বড় টপিক, এ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। 

সেদিন যে অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা, সুতরাং সেখানে স্বাভাবিকভাবেই বেশ ভিড় জমিয়েছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সাংবাদিকেরা। অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়েছিল যদিও বেশ সাদামাটাভাবেই, আইনস্টাইনের কর্মক্ষেত্র প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেই। আর ওই পার্টির শেষে সবাই যখন বেরিয়ে আসছেন, সাংবাদিকেরা আরও একবার উন্মুখ হয়ে পড়ে আইনস্টাইনের ছবি তোলার জন্য। কিন্তু তিনি তো বেশ ক্লান্ত, বেরিয়ে এসে সোজা উঠে পড়েন একটি লিমুজিন গাড়িতে। সেই গাড়িতে তাঁর দুই পাশে বসেছিলেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডির প্রাক্তন ডিরেক্টর ডঃ ফ্রাঙ্ক অ্যাডিলোটে এবং ফ্রাঙ্ক সাহেবের স্ত্রী মারি জেনেট। সাংবাদিকেরা এসে ঘিরে ধরলেন সেই গাড়ি। ক্লান্ত আইনস্টাইন বেশ বিরক্ত হয়ে তো বলেই ফেললেন, ‘দ্যাটস এনাফ!’ কিন্তু কে শোনে কার কথা! হুড়োহুড়ি হতেই লাগল তাঁর ছবি তোলা আর তাঁর বাইট নেওয়ার জন্য, সঙ্গে চিৎকার, ‘প্রোফেসর, বার্থডে উপলক্ষ্যে একটু তো হাসুন’। কিছুটা রাগ আর কিছুটা বিরক্তি নিয়েই তখন আইনস্টাইন করলেন কি, বাইরের দিকে তারিখে বের করে দিলেন লম্বা জিভটি। যে সাংবাদিকটি সবচেয়ে সামনেই ছিলেন, তিনিও কালবিলম্ব না করে টিপে দিলেন শাটার আর ফ্লাশিং বাল্ব। 


ছবি ১) ভেংচিরত আইনস্টাইন। আর্থার স্যাশে-র তোলা, ১৪ মার্চ ১৯৫১; মূল ছবি প্রচ্ছদে। 

ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল-এর চুয়াল্লিশ বছর বয়সী ফটোগ্রাফার আর্থার স্যাশে সেদিন নিমন্ত্রিত ছিলেন ওই পার্টিতে। গাড়ির বাইরে থেকে যে সাংবাদিকেরা আইনস্টাইনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছিলেন, তাঁদের মধ্যেও হাজির ছিলেন আর্থার। ক্ষণিকের ওই দুর্লভ মুহূর্তের ছবি তুলতে সেদিন একমাত্র পেরেছিলেন তিনি। অন্য কোনো ফটোগ্রাফার যে ছবি তুলতে পারেননি মুহূর্তের মধ্যে রেডি না হতে পারবার জন্য বা অন্য কারণে (আজকের দিনে হলে যেটা ঘটত না একেবারেই), সেই মুহূর্তের ছবি ক্যামেরাবন্দি করে তিনি তো ফিরে গেলেন বাড়ি। 


ছবি ২) ফটোগ্রাফার আর্থার স্যাশে (১৯০৮-১৯৭৫)

পরে সংবাদপত্রে সেই ছবি প্রকাশিত হলে, তা নজরে এল স্বয়ং আইনস্টাইনের। আর এমনিতে তিনি আর যাই হন, রসবোদ্ধা ছিলেন না, এমন অপবাদ দেবে না কেউই। তিনি বেশ পছন্দ করে ফেললেন ছবিটিকে, আর অনুরোধ জানালেন আর্থারকে, যেন তাঁকে ওই ছবিটির বেশ কয়েকটি প্রিন্ট উপহার দেওয়া হয়। আর্থার অবশ্যই সে অনুরোধ মেনে আইনস্টাইনকে মোট নয়টি কপি উপহার দেন। আইনস্টাইনও মনের আনন্দে সেই ছবিগুলি থেকে নিজের মুখটিকে আলাদাভাবে কেটে নিয়ে সেটা গ্রিটিংস কার্ডের সঙ্গে জুড়ে বিলিয়ে দেন চেনাপরিচিতদের মধ্যে। পরেও আরও অনেক কপি তিনি এরকমভাবে বন্ধুদেরকে উপহার দিয়েছিলেন। তিনি একবার মজা করে বলেওছিলেন, ‘The outstretched tongue reflects my political views’। তারপরে তো ইতিহাস। ছবিটি যেন রসিক আইনস্টাইনের সঙ্গে সমার্থক হয়ে পড়ল। অসংখ্য কফিমাগ, টি-শার্ট আর গ্রিটিংস কার্ডে শোভিত হতে থাকলেন ভেংচি-কাটা আইনস্টাইন। আর্থার স্যাশেও অন্য যত ছবি তুলেছেন সারা কেরিয়ারে, সবকিছুকে ছাপিয়ে ওই একটা ছবিই তাঁকে এনে দিয়েছে স্থায়ী খ্যাতি। 


ছবি ৩) সেদিন গাড়ির মধ্যে থাকবার সময় আর্থার স্যাশে-র তোলা আরও একটি ছবি 

সত্তর বছর পেরিয়েছে এই ছবির বয়স। আইনস্টাইন পৃথিবী ছেড়েছেন এই ছবি তোলার বছর চারেক বাদে। অথচ ছবিটির জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি আজও, বরং বেড়েছে অনেকটাই। একটা নমুনা, তাঁর স্বাক্ষর করা এই ছবির একটি কপি ২০০৯ সালে নিলামে বিক্রি হয় পঁচাত্তর হাজার ডলারে, ভারতীয় মুদ্রায় যা তখন ছিল প্রায় চল্লিশ লাখ টাকা। আজকের দিনে এই পরিমাণ বেড়েছে অনেকটাই। আর এটাই আজ পর্যন্ত কোনো ফোটোগ্রাফের সবচেয়ে বেশ দামে বিক্রি হওয়ার রেকর্ড বহন করছে। 

সমস্ত মানুষ-জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর মনোভাবের প্রকাশ যেন ওই মুখভঙ্গিমাই। আজকের দিনে, বিশ্ব জুড়ে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর মধ্যমেধার দাপট, এ দেখলে আইনস্টাইন নিশ্চিতভাবেই ওইরকমভাবেই হেসে উঠতেন আরও একবার। 

....................................... 


#আইনস্টাইন #অর্পণ পাল #সিলি পয়েন্ট #ফিচার #বাংলা পোর্টাল #Einstein #silly point #Arpan Pal #web portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

60

Unique Visitors

182605