নিবন্ধ

যিনি রাঁধেন, তিনি গল্পও ফাঁদেন

শৌভিক মুখোপাধ্যায় Oct 11, 2020 at 3:44 pm নিবন্ধ

বই আর ফুল ছাড়া তাঁকে ভাবা যায় না। একা মানুষ। সারাদিন কাটে বাগান করে আর সাহিত্যচর্চায়। কারও সঙ্গে দেখা করতে গেলে উপহার হিসেবে নিয়ে যান বাগানের গোলাপ অথবা অর্কিড। যদি কেউ মুখ ফুটে ফুলের চারা বা গাছের বীজ জোগাড় করে দিতে বলে, যেভাবেই হোক খুঁজে এনে দেন। মাঝেমধ্যে সময় পেলেই ঘুরে আসেন বাগান থেকে। কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ফুটে ওঠাটুকু দেখবেন বলে। বাড়ির অন্যান্য সদস্য বলতে রাঁধুনি ‘বাবাজি’ আর পোষ্য ‘পাহারা’। সাধাসিধে, নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। অবসরে লেখালিখি করেন বটে, তবে তা ছাপার অক্ষরে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা সম্পাদকের তাগাদার সঙ্গে সমানুপাতিক। আরও একটা বিষয়ে দিনের খানিকটা তুলে রাখেন সযত্নে। নানারকম রান্না নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা। শুধু খাওয়া নয়, রেঁধে খাওয়ানোতেই বেশি তৃপ্তি তাঁর। সবাই অবশ্য এ খবর জানে না। মিতবাক, মিতাহারী, স্বভাবগম্ভীর মানুষটির নাগাল যারা পায়, তারা জানে, যিনি গল্প ফাঁদেন, তিনি রাঁধেনও বটে। তাঁর নাম সতীনাথ ভাদুড়ী।

প্রথাগত অর্থে সংসারী ছিলেন না তিনি। কিন্তু সামাজিক ক্রিয়াকর্মে এগিয়ে আসতেন সবার আগে। বাড়ি সারানোর প্ল্যান থেকে ভাইঝির বিয়ে সবেতেই তিনি সবার আগে। তেমনই পারদর্শী ছিলেন আতিথেয়তায়। মেনুকার্ডে অবশ্যই থাকত মিষ্টি। নিজেও সন্দেশ খেতে ভালবাসতেন খুব। স্নেহধন্য অনুজ বীরেন ভট্টাচার্য স্মৃতিচারণে জানিয়েছেন, “রান্না করা ও মিষ্টি তৈরি করাতে সতুদার সখ ছিল প্রচুর। নারকেল নাড়ু, গোকুল পিঠে, নারকেল চিংড়ি, দইবড়া নিজের হাতে বানিয়ে আমাদের খাইয়েছেন অনেকবার।” মিষ্টিপ্রেম ধরা পড়েছে তাঁর লেখাতেও। ‘জাগরী’ উপন্যাসের ‘আওরত কিতা’ অংশে বিলুর মার সংলাপে খাদ্যরসিক সতীনাথ লিখেছিলেন - 

“সরস্বতী কি শুক্‌তো রাঁধতে জানে? গোকুলপিঠের নাম শুনেছে? বিলু অড়রের ডাল পছন্দ করে না। আর ওরা অড়রের ডাল ছাড়া আর অন্য কোনও ডাল ভালোবাসে না।”

…এরা কি একটা ভালো মিষ্টি তোয়ের করতে জানে? মিষ্টির মধ্যে ঐ এক ‘পুয়া’— সব পূজায়-আচ্চায়, ঝোলে, অম্বলে সর্বঘটে আছে। জলে একটু আটা গুলে নিয়ে, তাতে একটু গুড় দিয়ে কোনোরকমে ভেজে ফেলতে পারলেই হয়ে গেল ‘পুয়া’। না আছে রসে ফেলা, না আছে কিছু।... আর তারই সঙ্গে আমি বিলুর বিয়ে দিতাম। এ তো আর এক দুদিনের কথা নয়। সারা জীবন রসুন আর গোলমরিচ খেয়ে কি আর বাঙালির ছেলে বাঁচতে পারে?”

মিষ্টি ছাড়া সতীনাথ সিদ্ধহস্ত ছিলেন টোষ্ট, ডিমের পুডিং ইত্যাদি তৈরিতেও। তবে সবচেয়ে আগ্রহের বিষয়বস্তু ছিল চা। দিনে একাধিকবার চা খেতেন। জেল-জীবনেও তা বজায় ছিল। শুধু খাওয়াই নয়, চমৎকার চা বানাতে পারতেন। ‘বিশ্ব প্রসিদ্ধ চা-রসিকদের খবর রাখতেন এবং তারা কে কত কাপ চা খেতেন সে হিসাবও তাঁর কন্ঠস্থ ছিল। পাঁচ পট চায়ের লিকারে যে নিকোটিন থাকে এক টুকরো সুপুরিতে যে তার চেয়ে অনেক বেশি থাকে ইত্যাদি তথ্যও তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে মনে রাখতেন।’ 

খাদ্যরসিক হলেও, পরিমাণের ক্ষেত্রে ছিলেন চূড়ান্ত সংযমী। পুরোদস্তুর রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বিহারের গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়ানোর সময় থেকেই অভ্যাস করেছিলেন স্বল্পাহার। সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে থাকার সময় একবার বন্ধুর বাড়ি নিমন্ত্রণে ভোজের আড়ম্বর দেখে বলেছিলেন, ‘দেশের লোক যখন এইরকম উপাদেয় খাবার খেতে পারবে, তখনই আমি এই সকল খাদ্য গ্রহণ করতে পারবো।’ কাটিহারের জুট মিলে ধর্মঘট হলে সতীনাথ ধর্মঘটীদের সঙ্গে একত্রে আহার, মাথায় ইঁটের বালিশ দিয়ে রাতকাটানো সব বিষয়েই সামিল ছিলেন। আলাদা কোনো ছুঁৎমার্গও ছিল না। জেলবন্দি জীবনেও বজায় ছিল এই সংযম। ‘সকালবেলা পাউরুটি, ডিমসেদ্ধর সঙ্গে চা খেতেন। তারপরে আবার এক- দুবার চা। দিনের বেলায় ভাত, আলুসেদ্ধ, কলাসেদ্ধ, দু-চামচ মাখন এবং দই। বিকেলবেলা বিস্কুটসহ চা। রাতে আবার চার স্লাইস পাউরুটি মাখন। এটাই সাধারণ ভাবে সতীনাথের আহার ছিল।’  

নিজে সামান্য খাবার দাঁতে কাটলেও সহবন্দিদের স্বাদবদলের জন্যে উপাদেয় পদ রান্না করে চমকে দিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার ছিল। প্রখ্যাত হিন্দি সাহিত্যিক ফণীশ্বরনাথ রেণু ভাদুড়ীজিকে নিজের সাহিত্যজীবনের গুরু বলে স্বীকার করেছিলেন। দীর্ঘদিন সতীনাথের সঙ্গে জেলে সহবন্দি হিসেবেও কাটিয়েছেন। তাঁর জবানিতে, ‘মুঙ্গের জেলার যমুনাবাবু ভালো রান্না জানতেন – প্রায় সব রকমের রান্না ওঁর জানা ছিল।... ভাদুড়ীজি একবার যমুনাবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন – আপ ‘কচুমর’ বনানা জান্‌তে হ্যাঁয় ? ওঁর এই প্রশ্ন শুনে ওখানে যাঁরা ছিলেন – সবাই হেসে ফেলেছিলেন। আমরা জানতাম যে মার মার কর ‘কচুমর’ বানানা একটা চালু হিন্দি প্রবাদ। যমুনাবাবু একদিন বাইরের থেকে বুনো ওল জাতীয় কোন আলুর পাতা আনিয়ে সযত্নে ‘কচুমর’ তৈরি করেছিলেন।’ এর পরিবর্তে ভাদুড়ীজি একটি ‘মোতঞ্জন’ (এক রকমের পোলাও) রান্না করে যমুনাবাবুকে অবাক করে দিয়েছিলেন। যমুনাবাবু নিরামিষভোজী ছিলেন। এককালে প্রচুর খেতেন। এখন রান্না করে অন্যদের খাইয়ে সুখ পান। উনি ভাদুড়ীজির তৈরি মোতঞ্জনের রং দেখে এবং ‘খুসবু’তেই বুঝেছিলেন –  ওস্তাদ হাতের রান্না। বললেন — হম্‌ তো সমঝতে থে কি আপ আলু কেলা সিদ্ধ করনা ছোড়কর আউর কুছভি নহী জানতে হ্যাঁয়। লেকিন আপতো সিদ্ধহস্ত পাক্‌শাস্ত্রী নিক্‌লে।’ 

সবকাজ নিজের হাতে করতে ভালবাসতেন সতীনাথ। মন দিয়ে বুঝতে চাইতেন খুঁটিনাটি। ‘অন্য কেউ তাঁকে জল গড়িয়ে দেবে একটু কিংবা ধুয়ে দেবে তাঁর ব্যবহৃত জামা-কাপড়— একথা তিনি ভাবতেও পারতেন না।’ নিজের দেবর সম্পর্কে স্মৃতিচারণে এ তথ্য জানিয়েছিলেন শ্রীমতী রেণুকা ভাদুড়ী। তাই হয়তো, কলমের পাশাপাশি, ফোড়নেও সমান দখল ছিল তাঁর। যত্নে শেখাতেন নানারকম পদ। ‘নিজের বৌদিকে কাছে বসে শেখাতেন নানারকম জেলি, পায়েস, পিঠে’। ঘনিষ্ঠরা তাঁর রান্নার তারিফ করলে মৃদু হেসে বলতেন, ‘এসব যে মেয়েদেরই একচেটিয়া ব্যাপার নয়, তা প্রমাণ করেছি তো?” 


কৃতজ্ঞতা স্বীকার:  

১) সতীনাথ ভাদুড়ী: জীবন ও সাহিত্য। শ্রী অরূপকুমার ভট্টাচার্য। সাহিত্য প্রকাশ। পরিবেশক: পুস্তক বিপণি।

২) সতীনাথ ভাদুড়ী গ্রন্থাবলী: ১। সম্পাদনা: শঙ্খ ঘোষ ও নির্মাল্য আচার্য। 



[কভার পোস্টার : অর্পণ দাস] 


#নিবন্ধ সিরিজ #সতীনাথ ভাদুড়ী #Satinath Bhaduri #রান্না #Cooking #silly পয়েন্ট #শৌভিক মুখোপাধ্যায়

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

39

Unique Visitors

182579